আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস ২০২৫ উপলক্ষে
আমাদের ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযুক্ত পৃথিবীতে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস এখন আর বিলাসিতা নয়—এটি অধিকার, সুযোগ ও ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রবেশদ্বার। কিন্তু বৈশ্বিক দক্ষিণের (Global Majority) লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য এই দরজাটি এখনও অর্ধেক বন্ধ। ডিজিটাল বিভাজন কেবল প্রযুক্তিগত ফাঁক নয়; এটি নির্ধারণ করে কারা শেখার, মত প্রকাশের, উদ্ভাবনের ও বিশ্ব গঠনে অংশ নেওয়ার ক্ষমতা রাখে—আর কারা প্রান্তে থেকে যায়।
যখন মানুষ তথ্য, প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অ্যাক্সেস পায়, তখন সেটি শুধু তাদের ক্ষমতায়নই করে না, বরং তাদের জীবনের গতিপথও পাল্টে দেয়।
আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবসের প্রেক্ষাপটে আমাদের অবশ্যই লিঙ্গভিত্তিক ডিজিটাল বিভাজনের গভীর প্রভাব উপলব্ধি করতে হবে। প্রতিটি পরিসংখ্যানের আড়ালে লুকিয়ে আছে অপুর্ণ সম্ভাবনার গল্প, হারানো সুযোগ, এবং অ্যাক্সেসের অভাবে থেমে যাওয়া জীবনের বাস্তবতা।
ডিজিটাল বিভাজন: শক্তির ব্যবধান
“ডিজিটাল বিভাজন” শব্দটি প্রায়ই প্রযুক্তির ভাষায় ব্যবহৃত হয়, অথচ মূলত এটি ন্যায়বিচার ও সমতার প্রশ্ন—যা শাসনব্যবস্থা, অর্থনীতি ও লিঙ্গবৈষম্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
প্রথম পর্যায়ে বিভাজন ছিল মূলত সংযোগের ওপর ভিত্তি করে—কে ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার পায়, আর কে পায় না।, ইন্টারনেট অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, ও ডিভাইস অ্যাক্সেস ছিল প্রধান বাধা। এটি প্রধানত শহর বনাম গ্রাম, ধনী বনাম দরিদ্র, এবং উত্তর বনাম দক্ষিণের পার্থক্যকে চিহ্নিত করেছিল।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ফোকাস চলে যায় ব্যবহার ও দক্ষতার ফাঁকে।
প্রশ্ন আর ছিল না “সংযোগ আছে কি?” বরং “কীভাবে এবং কেন ব্যবহার করা হচ্ছে?” ডিজিটাল সাক্ষরতা, ভাষা, কনটেন্ট, এবং নিরাপদ অনলাইন উপস্থিতি ছিল মূল চ্যালেঞ্জ। সামাজিক মাধ্যম, ই-গভর্নেন্স ও ডিজিটাল অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ এখানেই নির্ধারিত হতে শুরু করে।
তৃতীয় ও বর্তমান পর্যায়ে বিভাজন আরও জটিল: এটি ক্ষমতা, ডেটা, ও অ্যালগরিদমিক নিয়ন্ত্রণের ওপর ভিত্তি করে।
প্রশ্ন হলো—কে ডিজিটাল যুগে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? কে ডেটা ও অ্যালগরিদম নিয়ন্ত্রণ করছে? এবং Platform Governance এখন বৈষম্যের নতুন ক্ষেত্র। নারীরা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও বৈশ্বিক দক্ষিণ এখন AI bias, data colonialism ও surveillance capitalism-এর শিকার।
অ্যাক্সেস মানেই শক্তি; আর অ্যাক্সেসের অভাব মানে কাঠামোগত বঞ্চনা।
আগামী পাঁচ বছরে ডিজিটাল বিভাজনের কারণে বৈশ্বিক দক্ষিণে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি দাঁড়াতে পারে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। কিন্তু এই ক্ষতি শুধু অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নাগরিক অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্যসেবা এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকারকেও ক্ষুণ্ণ করে।
বঞ্চনার বহুমাত্রিক প্রভাব
ডিজিটাল বঞ্চনার প্রভাব মূলত পাঁচটি ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়:
অর্থনীতি, শিক্ষা, তথ্য, উদ্ভাবন, এবং সংকটকালীন সহনশীলতা।
১. অর্থনৈতিক বঞ্চনা
ITU-এর গবেষণা অনুযায়ী, ব্রডব্যান্ড সংযোগের সঙ্গে GDP বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। তবু আফ্রিকায় মাত্র ৩০% মানুষ নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পান। ২০২০ সালে লিঙ্গভিত্তিক ডিজিটাল বৈষম্যের কারণে কিছু দেশে GDP ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১২৬ বিলিয়ন ডলার, আর গত দশকে এ ক্ষতির পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
২. শিক্ষা
ডিজিটাল সংযোগের অভাবে শিক্ষার বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। কোভিড-১৯ মহামারী দেখিয়েছে, ডিজিটাল শিক্ষাই টিকে থাকার চাবিকাঠি—কিন্তু শুধুমাত্র তাদের জন্য, যাদের অ্যাক্সেস ছিল। গ্রামীণ মেয়েরা ইন্টারনেট, ডিভাইস ও নিরাপদ অনলাইন পরিবেশের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। UNESCO-এর মতে, শিক্ষা ও ডিজিটাল বিভাজন উভয় ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব অর্থনীতিতে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
৩. তথ্য-দারিদ্র্য ও নাগরিক বঞ্চনা
ডিজিটাল তথ্যের অভাবে মানুষ শুধু অজ্ঞ নয়—তারা বঞ্চিতও। গ্রামীণ নারীরা প্রায়ই স্বাস্থ্য, কৃষি ও নাগরিক সেবার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে, যা তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ সীমিত করে।
৪. উদ্ভাবনে বাধা
ডিজিটাল টুল ও নেটওয়ার্কে প্রবেশাধিকার ছাড়া উদ্ভাবন সম্ভব নয়। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিলের মাত্র ২.৩% নারী-নেতৃত্বাধীন দলগুলোর হাতে গেছে, বাকিটা পুরুষ-নেতৃত্বাধীন উদ্যোগে। এই বৈষম্য প্রমাণ করে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্ভাবন ইকোসিস্টেম গঠন এখন সময়ের দাবি।
৫. সংকটকালীন ঝুঁকি বৃদ্ধি
সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন বা স্বাস্থ্য সংকটের সময় ইন্টারনেটবঞ্চিত জনগোষ্ঠী গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা ও তথ্য থেকে বঞ্চিত থাকে, যা তাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। নারী ও কন্যাশিশুরা এই ঝুঁকির ভার সবচেয়ে বেশি বহন করে।
বঞ্চনার লিঙ্গ ও বর্ণভিত্তিক বাস্তবতা
ডিজিটাল বিভাজন একরৈখিক নয়; এটি বহুমাত্রিক—লিঙ্গ, বয়স, বর্ণ, সক্ষমতা ও ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী প্রভাব ফেলে।
গ্রামীণ, প্রবীণ, ও প্রতিবন্ধী নারীরা প্রায়ই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক বিধিনিষেধ ও ডিজিটাল অদৃশ্যতা তাদের অগ্রগতি রোধ করে।
যদিও উচ্চাভিলাষী ব্রডব্যান্ড প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তবুও উচ্চ খরচ, সীমিত অবকাঠামো ও ডিজিটাল দক্ষতার ঘাটতি এখনো বড় বাধা। তাই অবকাঠামোর পাশাপাশি ডিজিটাল ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
গঠনমূলক পরিবর্তনের আহ্বান
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবকেন্দ্রিক ডিজিটাল ভবিষ্যৎ গড়তে হলে দরকার বাস্তব পদক্ষেপ:
• কমিউনিটি-ভিত্তিক সংযোগে বিনিয়োগ করুন: মানুষকে মুনাফার উপরে স্থান দিন।
• নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রে আনুন: তারা যেন শুধুমাত্র সুবিধাভোগী নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হন।
• ইন্টারনেটকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিন: সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেটকে জনসাধারণের পণ্য হিসেবে বিবেচনা করুন।
অ্যাক্সেসই ভিত্তি, চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়
সত্যিকারের অ্যাক্সেস মানে কেবল সংযোগ নয়; এটি দক্ষতা, সুরক্ষা, ডিজিটাল জ্ঞান ও আত্মবিশ্বাসের সমন্বয়।
এটি মানুষকে নিজের গল্প বলার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এবং সমষ্টিগতভাবে পরিবর্তন আনার শক্তি দেয়।
যদি আমরা ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যৎ গড়তে চাই, তবে প্রশ্নটি হওয়া উচিত—
“কে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে?” কে নয়,
বরং “কে ডিজিটাল যুগে ক্ষমতাবান হচ্ছে, আর কে নয়?”
ডিজিটাল বঞ্চনাকে উপেক্ষা করা মানে ভবিষ্যতের ন্যায়বিচার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। এখনই সময় ন্যায্য, সাশ্রয়ী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অ্যাক্সেস নিশ্চিত করার—
যা সবার জন্য রূপান্তরমূলক ডিজিটাল অগ্রগতি বয়ে আনবে।
এ. এইচ. এম. বজলুর রহমান | ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি), এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাষ্ট্রদূত, নীতি গবেষণা ফেলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে গণমাধ্যম, তথ্যের অখণ্ডতা ও সমাজ! ceo@bnnrc.net
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে পদোন্নতিতে অনিয়ম ও অসঙ্গতির অভিযোগে দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট রুল জারি করেছেন। একই সঙ্গে আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পদোন্নতি সংক্রান্ত যেকোনো কার্যক্রম অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে। দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকটির ১০ম গ্রেডের পদোন্নতি–বঞ্চিত কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে ন্যায্য পদোন্নতির দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে আসছিলেন। দাবি আদায়ে বারবার কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন ও মানববন্ধন করেও সাড়া না পেয়ে তারা শেষ পর্যন্ত আদালতের দ্বারস্থ হন। সূত্র জানায়, পদোন্নতি–বঞ্চিত কর্মকর্তারা গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর (শনিবার) ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ছুটির দিনে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন করেন, যাতে গ্রাহকসেবা ব্যাহত না হয়। তাদের দাবির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খান দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেন। তবে তিন মাস পার হলেও প্রতিশ্রুত আশ্বাস বাস্তবায়িত না হওয়ায় তারা পুনরায় ওই বছরের ৩০ নভেম্বর মানববন্ধনের আয়োজন করেন। এতে সারা দেশের শাখা থেকে ১২০০–এর বেশি কর্মকর্তা অংশ নেন। পরদিন (১ ডিসেম্বর) বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিনতে আলী পদোন্নতির বিষয়ে মৌখিক আশ্বাস দিলে আন্দোলনকারীরা কর্মস্থলে ফিরে যান। পরে কর্মকর্তাদের জানানো হয়, সুপারনিউমারারি পদ্ধতিতে মার্চের মধ্যে পদোন্নতির বিষয়টি সমাধান করা হবে। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে অগ্রণী, জনতা, রূপালী ও সোনালী ব্যাংকে ইতোমধ্যে মোট ৭,৩১৬ কর্মকর্তা এই পদ্ধতিতে পদোন্নতি পেয়েছেন, যা অর্থ মন্ত্রণালয়ও অনুমোদন করেছে। পদোন্নতি–বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের এই উদাসীনতা তাদের প্রতি কর্মীবান্ধবহীন মনোভাব ও কর্তৃপক্ষের অনীহারই প্রকাশ। তারা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের পর অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিবর্তন এলেও কৃষি ব্যাংকে আগের প্রশাসনিক কাঠামো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে, যা ন্যায্য দাবি আদায়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অভিযোগ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক ও মানবসম্পদ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক জাহিদ হোসেন একাধিক বৈঠকে আশ্বাস দিলেও বাস্তব পদক্ষেপ না নিয়ে বরং আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তাদের হয়রানি ও নিপীড়ন করা হয়েছে। ফলে তারা বাধ্য হয়ে এ বছরের চলতি মাসে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন (রিট মামলা নং: ১৬৪২৮/২০২৫, মো. পনির হোসেন গং বনাম রাষ্ট্র ও অন্যান্য)। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট রুল জারি করে জানতে চেয়েছেন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পদোন্নতিতে দেখা দেওয়া অনিয়ম ও অসঙ্গতি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। পাশাপাশি আদালত নির্দেশ দিয়েছেন, রুল নিষ্পত্তির আগে কোনো পদোন্নতি কার্যক্রম শুরু করা হলে তা অবৈধ ও আদালত–অবমাননার শামিল হবে। রিটে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক পদোন্নতিতে ১০৭৩ জন কর্মকর্তা (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে মূখ্য কর্মকর্তা) এবং ৫১ জন মূখ্য কর্মকর্তা (ঊর্ধ্বতন মূখ্য কর্মকর্তা পদে) অনিয়মের মাধ্যমে পদোন্নতি পেয়েছেন। এদিকে জানা গেছে, পূর্বে দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত মানবসম্পদ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক জাহিদ হোসেন এখনো পদোন্নতি কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। পদোন্নতি–বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অমান্য করে যদি পুনরায় অনিয়মের পথে যাওয়া হয়, তাহলে তা আদালতের অবমাননা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল হবে। তারা আশা করছেন, এ বিষয়ে দ্রুত ন্যায়বিচার ও সমাধান মিলবে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে সাম্প্রতিক সময়ে পদোন্নতি ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন ‘বৈষম্য বিরোধী অফিসার্স ফোরাম’ এর কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক মো. পনির হোসেন ও সদস্য সচিব এরশাদ হোসেনকে শৃঙ্খলাজনিত মোকদ্দমা এবং মুখ্য সংগঠক মো. আরিফ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া মুখপাত্র তানভীর আহমদকে দুর্গম অঞ্চলে বদলি করা হয় এবং সারাদেশের দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, মো. আরিফ হোসেনকে বরখাস্ত করার নথিতে তাকে ‘ব্যাংক ও রাষ্ট্রবিরোধী’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, অথচ ব্যাখ্যা তলবপত্রে বলা হয় তিনি ‘রাজনৈতিক কাজে তহবিল সংগ্রহ করেছেন।’ ফরেনসিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তার ব্যাখ্যাতলবের জবাব প্রদানের পরও বরখাস্ত চিঠি আগেই তৈরি করা হয়েছিল, যা অনেক কর্মকর্তার মধ্যে প্রশ্ন তোলেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহাব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তারা যদি সংবিধান বা আইন অনুযায়ী দায়িত্ব না পালন করেন, হাইকোর্ট তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ বা অপব্যবহার রোধের জন্য আদেশ দিতে পারে। অন্য একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, এ সিদ্ধান্তের পেছনে ব্যাংকের ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগী একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, পদোন্নতি ও ন্যায়বিচারের জন্য আন্দোলন এবং আইনি লড়াই চলবে। ভুক্তভোগী কর্মকর্তারা শিগগিরই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে প্রতিকার চাইবেন। এ ব্যাপারে মো. আরিফ হোসেন ও পনির হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে একটি ভুয়া কর্মচারী ইউনিয়নের সভায় জোরপূর্বক কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ করানোর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ব্যাংকের ভিজিল্যান্স স্কোয়াডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাসলিমা আক্তার লিনা ও তার স্বামী মিরাজ হোসেন। গত ২০ অক্টোবর প্রধান কার্যালয়ের অডিটোরিয়ামে ‘বিশেষ সাধারণ সভা’ নামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (সিবিএ) নামে তারা এটির আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান ও উদ্বোধক হিসেবে জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদলের সভাপতি আনোয়ার হোসাইনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে তারা প্রকাশিত খবরের মাধ্যমে ভুয়া নেতাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত হয়ে অনুষ্ঠানটি বয়কট করেন। অভিযোগ রয়েছে, তাসলিমা আক্তার লিনা হেড অফিসের বিভিন্ন দপ্তরের নারী কর্মকর্তা এবং তার স্বামী মিরাজ হোসেন পুরুষ কর্মকর্তাদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে ওই সভায় অংশগ্রহণে বাধ্য করেন। অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে বদলি বা পদোন্নতি রোধের হুমকিও দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। হেড অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, লিনা তার স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে নারী সহকর্মীদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে আসছেন। কেউ আপত্তি জানালে মিরাজের সহযোগীরা এসে অশালীন আচরণ ও গালিগালাজ করে থাকে বলেও অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া, লিনা ‘উইমেনস ফোরাম’ নামে একটি সংগঠন গড়ে মাসিক চাঁদা সংগ্রহ করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার এই কর্মকাণ্ডে অনেক নারী কর্মকর্তা বিব্রতবোধ করলেও চাকরির স্বার্থে নীরব থাকছেন। অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, মানবসম্পদ বিভাগের ডিজিএম জাহিদ হোসেনের প্রত্যক্ষ সহায়তায় তাসলিমা আক্তার লিনা ও তার স্বামী মিরাজ ব্যাংকের অভ্যন্তরে প্রভাব বিস্তার করছেন। এ ঘটনায় নারী কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা কর্তৃপক্ষের কাছে তাসলিমা আক্তার লিনা ও মিরাজ হোসেনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে তাসলিমা আক্তার লিনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি নিয়ম অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছি, অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। অন্যদিকে, মিরাজ হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে সংঘটিত এজাহারভুক্ত হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ ও মিরাজ হোসেন পলাতক রয়েছেন। ব্যাংক প্রশাসন বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। খুনের শিকার কৃষি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী আব্দুল হালিম ছিলেন কৃষি ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায়। পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি স্থানীয়ভাবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। মামলার বিবরণ অনুযায়ী, ১ নম্বর আসামি হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত পিয়ন ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ এবং ২ নম্বর আসামি মিরাজ হোসেনের নাম রয়েছে। তারা বর্তমানে নিজেদের সিবিএ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দাবি করে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করছেন। ব্যাংক সূত্রে গেছে, তারা চাঁদাবাজি, ঘুষ আদায় ও নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। সূত্র জানায়, ব্যাংকের ভেতরে একটি সিন্ডিকেটের প্রভাবেই এসব আসামিরা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে আছেন মানবসম্পদ বিভাগের ডিজিএম জাহিদ হোসেন। এতে আরও যুক্ত রয়েছেন ডিজিএম সৈয়দ লিয়াকত হোসেন, হাবিব উন নবী, ডিএমডি খালেকুজ্জামান জুয়েল ও ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সঞ্চিয়া বিনতে আলী। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর রাতে মতিঝিলের বিমান অফিসের সামনে আব্দুল হালিমের মৃত্যু হয়। পরদিন সকালে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক সজীব কুমার সিং সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে জানান, পুরনো সহকর্মীদের সঙ্গে বিরোধের জেরে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং রাত ১টা ৪০ মিনিটে হাসপাতালে মারা যান। হালিমের ছেলে ফয়সাল বলেন, তার বাবা ২০১৪ সাল থেকে কৃষি ব্যাংক সিবিএর সভাপতি ছিলেন এবং বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতেন। ইউনিয়নের নেতৃত্ব ও পদ নিয়ে সহকর্মীদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। এ নিয়ে গত নভেম্বরেই মতিঝিল থানায় একটি জিডি (নং ০৫/১১/২০২৪ - ৩৩৫) করেছিলেন তার বাবা। তিনি আরও বলেন, বুধবার রাতে আমার বাবাকে তার অফিসের সহকর্মীরা মারধর করে হত্যা করেছে। সিবিএর বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নাসিম আহমেদ জানান, ২০১৪ সালে আমরা নির্বাচিত হই। এরপর আর কোনো নির্বাচন হয়নি। কিন্তু গত ৫ আগস্ট বিনা নির্বাচনে নতুন কমিটি ঘোষণা করে আমাদের অফিস দখল করে নেয় ফয়েজ ও মিরাজ। এ নিয়ে মামলা চলছে। মামলার তথ্য অনুযায়ী, আসামিরা অস্থায়ী জামিনে ছিলেন। সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েকজন পলাতক রয়েছেন—যাদের মধ্যে আছেন ড্রাইভার সাইফুল, শাহেদ, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মেহেদী ও অবসরপ্রাপ্ত ক্লিনার সিরাজ। এদিকে, মামলার ২ নম্বর আসামি মিরাজ হোসেন নৈমিত্তিক ছুটির আবেদন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যদিও ওয়ারেন্টভুক্ত আসামির নৈমিত্তিক ছুটি পাওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। মানবসম্পদ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক এ বিষয়ে বলেন, তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু স্থানীয় মুখ্য কার্যালয়ের প্রধান মহাব্যবস্থাপক জানান, তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। কারণ ব্যবস্থাপনা পরিচালক মন্তব্য না করার নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। অভ্যন্তরীণ এই পরিস্থিতিতে কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
অভিনব কায়দায় চাঁদাবাজিতে নেমেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের একদল ভুয়া সিবিএ নেতা। অভিযোগ উঠেছে, তারা বিশেষ সাধারণ সভা আয়োজনের নামে সারা দেশের শাখাগুলো থেকে কোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায় করছে। তথ্যসূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন (সিবিএ), রেজি. নং বি-৯৮৫-এর নাম ব্যবহার করে আগামী ২০ অক্টোবর ‘বিশেষ সাধারণ সভা’ শিরোনামে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের ঘোষণা দেয় একদল ভুয়া নেতা। এ উপলক্ষে তারা ব্যাংকের প্রায় ১ হাজার ২৫০টি ইউনিট থেকে ১০-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার উঠে। গোপন সূত্র জানায়, তাদের নিয়ন্ত্রিত লোকজন শাখা পর্যায়ে বদলি ও পদোন্নতির ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন উপ-মহাব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, তারা এসব কর্মকাণ্ডে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করলেও এ সিন্ডিকেটের ভয়ে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না। এ ঘটনায় ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগের ডিজিএম জাহিদ হোসেনের প্রত্যক্ষ মদদ ও আস্কারায় চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রাপ্ত আমন্ত্রণপত্রে দেখা গেছে, ভুয়া সভাপতি দাবিকারী কৃষি ব্যাংকের সাবেক পিয়ন ফয়েজ আহমেদ ও ভুয়া সাধারণ সম্পাদক মিরাজ হোসেন স্বাক্ষরিত পত্রে প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, উদ্বোধক হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন এবং প্রধান বক্তা হিসেবে সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম খান নাসিমকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কয়েকজন মহাব্যবস্থাপক জানান, তারা বিভিন্ন শাখা থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পেয়েছেন এবং বিষয়টি ব্যবস্থাপনা পরিচালক অবগত আছেন বলে জানানো হয়েছে। অনুষ্ঠানটি কৃষি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত হওয়ায় তারা কার্যত কিছু করতে পারছেন না। অনুসন্ধানে জানা যায়, এর আগেও একই সিন্ডিকেট শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রায় ৫০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছিল। সেই টাকা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, চাঁদাবাজ ও তাদের মদদদাতাদের সঙ্গে দলের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা বহিরাগত অনুপ্রবেশকারী। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব ভুয়া সিবিএ নেতাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও অবাঞ্ছিত ঘোষণা দাবি করেছেন। তাদের আশঙ্কা, এসব কর্মকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে পড়তে পারে।