মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্ঘাত-সহিংসতা চরম আকার ধারণ করেছে। পতন ঘটেছে মংডু অঞ্চলে সামরিক জান্তার সর্বশেষ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ঘাঁটির। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ)।
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মংডু শহর দখল করে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আর্মি (এএ)।
সশস্ত্র এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি জানিয়েছে, তারা জান্তার শেষ অবশিষ্ট সীমান্ত ঘাঁটি মংডু শহরের বাইরে অবস্থিত বর্ডার গার্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন নম্বর ৫ বেশ কয়েক মাস লড়াইয়ের পর রোববার সকালে দখল করেছে।
রাখাইনের মিডিয়া সোমবার জানিয়েছে, মংডুর এই যুদ্ধের পরে প্রায় ৮০ জন রোহিঙ্গা বিদ্রোহীসহ সরকারি সৈন্যদের পাশাপাশি সামরিক অপারেশন কমান্ড ১৫ -এর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থুরেইন তুনকে গ্রেফতার করেছে আরাকান আর্মি। মে মাসের শেষের দিকে মংডু আক্রমণ শুরু করে তারা। আর সীমান্তবর্তী এই শহরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে ছয় মাস সময় লাগল গোষ্ঠীটির।
এদিকে মিয়ানমারের এ ঘটনার পর চলমান সহিংতা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলাচলরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলার দেখলেই গুলি ছুড়ছে বিদ্রোহীরা। এমন পরিস্থিতিতে কক্সবাজারের টেকনাফজুড়ে স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
মংডু দখলের পর সেখানে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞের আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশে থাকা স্বজনরা। আরাকান আর্মির এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করছেন। অন্য দিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চক্রান্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভারী অস্ত্র ঢুকিয়ে সেখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ভারী অস্ত্র প্রদর্শনের ফলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভয়ে আছেন ক্যাম্পের মাঝি ও সাধারণ রোহিঙ্গারা।
একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত ৮ ডিসেম্বর সকালে মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির হাতে কক্সবাজার-বান্দরবান সীমান্তবর্তী তুমব্রু কোনারপাড়ার ওপারে মিয়ানমারের মংডু অঞ্চলে সামরিক জান্তার সর্বশেষ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ঘাঁটির পতন ঘটেছে। সেখানে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ ও তুমুল গোলাগুলি চলছে। ওই অঞ্চল থেকে টেকনাফের দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার হওয়ায় আরাকান আর্মির তোপের মুখে মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশ অনুপ্রবেশের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্র আরো জানায়, সুসম্পর্ক না থাকায় মংডু দখলের পর আরাকানিরা সেখানের মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢল নামার আশঙ্কা রয়েছে।
গোয়েন্দাদের অপর একটি সূত্র জানায়, এ অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র প্রবেশ করিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ অশান্ত করারও চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। পুরো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দেশটির চক্রান্তে ডিসেম্বরজুড়ে এ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।
এ ছাড়া নাফ নদে গত রোববার থেকে কোনো নৌকা চলাচল করলে আরাকান আর্মি তাদের উদ্দেশে গুলিবর্ষণ করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) গোয়েন্দাপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: ইয়াসির জাহান হোসেন নয়া দিগন্তকে গতকাল রাতে বলেন, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। আর একটি রোহিঙ্গাও যেন অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে বিজিবি সদস্যরা।
সর্বশেষ গত ২৯ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্ঘাত-সহিংসতার তোপের মুখে ফের বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ১২ হাজার রোহিঙ্গা। তাদের নতুন করে তালিকায় না রাখায় অবৈধভাবেই জীবনযাপন করছে তারা।
চলতি মাসের শুরুতে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের মংডুতে তীব্র সঙ্ঘাতের কারণে জনপ্রতি ২০ হাজার টাকায় চুক্তিতে দালালদের মাধ্যমে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। প্রায় অর্ধশত দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছে বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।