হুমকির মুখে সুন্দরবন

0
636

বাগেরহাট প্রতিনিধি:
অব্যহত গাছ চুরী তো আছেই তার উপর রোগবালাই সহ নানা কারণে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে ১৫ শতাংশ সুন্দরী, পশুর ও কেওড়া গাছ বিলুপ্ত হয়েছে। অপরিকল্পিত ঘের ভেড়ী ও অনিয়ন্ত্রিত স্লুইচ গেটের কারনে নদীর প্রবাহ না থাকায় নদ-নদী ভরাট হওয়া সহ ফারাক্কা বাঁধের কারনে লোনা ও মিষ্টি পানি প্রবাহের একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সম্মিলন না ঘটায় সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী গাছে টপডাইং, গলরোগ, পশুর গাছে হাটরট, ডাইব্যাক, কেওড়া গাছে ব্যাপক হারে ডাইব্যাক রোগের কারনে মরে গেছে এই ৩ প্রজাতির ১৫ শতাংশ গাছ। প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরীসহ মরে যাওয়া এই ৩ প্রজাতির গাছের শূন্যস্থান পূরণ করেছে গেওয়া ও গরান গাছ। ৫০ শতাংশ নতুন স্থানে গেওয়া ও গরান জন্ম নিচ্ছে। সুন্দরবনের সুন্দরী, পশুর ও কেওড়া গাছ রোগাক্রান্তের মধ্যে রয়েছে ৬, ১৪, ১৯, ২০, ২১, ২৫, ২৬, ২৭, ২৮, ৩২, ৩৩, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ নম্বার কম্পার্টমেন্ট। গত ৩০ বছরে টপ ডাইংয়ে আক্রান্ত সুন্দরবনে এক দশমিক ৪৪ মিলিয়ন ঘনমিটার সুন্দরী গাছ বিনষ্ট হয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ২ হাজার কোটি টাকার অধিক।
ওয়ার্ল্ড হ্যরিটেজ সাইড সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৪ হাজার ১৪৩ বর্গ কিলোমিটার হলো স্থল ভাগ। এই স্থল ভাগে যেখানে ১৯০৩ সালের জরিপে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদরাজি বিদ্যমান ছিলো,উজান মিষ্টি পানির প্রবাহ না থাকায় ২০১৫ সালের সীলস্ প্রকল্পের সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনে উদ্ভিদরাজির সংখ্যা আশংকাজনক হারে কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৮৪টিতে। এই অবস্থার মধ্যে প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরীসহ ৩ প্রজাতির গাছ রোগাক্রান্ত হয়ে ১৫ শতাংশ হারে মরে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ম্যানগ্রোভ বন এমন একটি বিশেষ প্রাকৃতিক পরিবেশে সৃষ্টি হয়,- যেখানে লোনা ও মিষ্টি পানি প্রবাহের একটি নির্দিষ্ট মাত্রার সম্মিলন ঘটে। লোনা ও মিঠা পানির এই মাত্রার হেরফের ঘটলে ম্যানগ্রোভ বনের ক্ষতি হয়। লোনা পানির আধিক্য সুন্দরী গাছের জন্য প্রাণঘাতি। দুর্ভাগ্যবশত সুন্দরবনে তাই হয়েছে। সুন্দরী গাছে টপডাইং, গলরোগ, পশুরের হাটরট, ডাইব্যাক, কেওড়ার ডাইব্যাক রোগ ছাড়াও কাকড়া, আমুর, শিংড়া, ধুন্দল গাছ লবণাক্ততার কারণে কমে যাচ্ছে। সুন্দরী গাছে টপডাইং, গলরোগ, পশুর গাছে হাটরট, ডাইব্যাক, কেওড়া গাছে ব্যাপক হারে ডাইব্যাক রোগের কারণগুলো হচ্ছে, মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নদ-নদীতে পলির আধিক হারে ভরাট হয়ে স্বাভাবিক জোয়ার-ভাটা বাধাগ্রস্ত হয়ে মাটির পুষ্টিগুন হ্রাস পাওয়াসহ গাছের ডগায় ও শেকড়ে কীটপতঙ্গ ও ছত্রাকের আক্রমণ, জলাবদ্ধতা এবং নানাবিধ প্রাকৃতিক পরিবর্তন। সুপার সাইক্লোন সিডর ও আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লম্বা সুন্দরী ও পশুর গাছ মারা যাওয়ায় নতুন করে এসব উদ্ভিদ জন্ম নিচ্ছে না।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্বপন সরকার তার নিজের গবেষণার কথা উল্লেখ করে বলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য কমে গেছে। সুন্দরী, পশুর, শিংড়া, আমুর, ধুন্দুল ও কাকড়া গাছের সংখ্যা কমে গেছে। সুন্দরবনে জন্ম নেয়া ১৫ শতাংশ সুন্দরী, পশুর ও কেওড়া গাছ মারা গেছে। পাটকোষ্টা, নীলকমল, গেওয়াখালি, আদাচাই, হরিণটানা, তাম্বুলবুনিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় রোগাক্রান্ত গাছের সংখ্যা বাড়ছে। ৫০ শতাংশ নতুন স্থানে গেওয়া ও গরান জন্ম নিচ্ছে। গোলপাতার জন্মহারও কমেছে।
পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাতের মতে, ফারাক্কার কারনে উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ না থাকার কারনে নদ-নদীতে মাত্রাতিক্ত লবনাক্তাতার কারনে সুন্দরবনে সুন্দরী গাছ মারা যাচ্ছে। এখানে সুন্দরী গাছের সংখ্যা ৮৫ কোটি ৬৭ লাখ। লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সুন্দরী ও পশুর গাছ মারা যাওয়ার সংখ্যা বাড়ছে।
বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. মাহমুদ হাসান জানান, সুন্দরবনে ২০০৭ সাল থেকে রোগাক্রান্ত আগামরা গাছ কাটা বন্ধ রয়েছে। শুষ্কো মৌসূমে সুন্দরবনের নদ-নদীতে লবণাক্ততা ৩০ পিপিএম পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। লবনাক্তার কারনে সুন্দরবনের উদ্ভিদরাজির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মিঠা পানিবাহী শিপসা, পশুর ও কপোতাক্ষ নদী পলি পড়ে ভরাট হয়ে পানি প্রবাহ কমে গেছে। এই অবস্থায় সুন্দরবনে দৃশ্যমান বড়-বড় সুন্দরী গাছ এখন দেখা যাচ্ছেনা। তবে এখনো সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী, গেওয়া ও গরানের পরিমান মোট উদ্ভিদরাজির ৭০ ভাগ।
খবর ৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here