খবর৭১:
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তুরস্কের পতাকা দেখতে পাওয়া মানেই হচ্ছে, একবেলা খাবার। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে নিপীড়িত এই সম্প্রদায়টির সদস্যদের মাঝে খাবার বিতরণ করে যাচ্ছে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সাহায্য সংস্থা ‘টার্কিশ কো-অপারেশন অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন এজেন্সি’ (টিকা)। তাদের ভাত, ডাল, মুরগির মাংস, তরকারি দিয়ে খাবারের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছে সংস্থাটি।
প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গার জন্য প্রতিদিন খাবারের ব্যবস্থা করছে তুরস্ক। এজন্য তাদের দৈনিক প্রয়োজন হয় ২৫ টন মালামাল। এরইমধ্যে ১০ হাজার কম্বল বিতরণ করেছে টিকা। রোহিঙ্গাদের জন্য ব্যবস্থা করেছে স্বাস্থ্যসেবার। সঙ্গে বাচ্চাদের জন্য তৈরি করেছে দিচ্ছে খেলার মাঠ।
তুরস্কের এই সহায়তা বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এর আগে কখনো তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক এতটা গভীর ছিল না বাংলাদেশের। রোহিঙ্গা সংকট অবস্থা পাল্টে দিয়েছে।
কক্সবাজারের কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের ইন্নাসুর রহমান বলেন, ‘এক সময় আমরা সারাদিন খাবারের জন্য বসে থাকতাম। ডাল-ভাত রান্না করার জন্য কোনো জ্বালানিও ছিল না।’ টিকার দেয়া সহায়তার কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘তারা আমাদের রান্না করা খাবার দেয়া শুরু করে।’
চলতি সপ্তাহেই বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছেন। দুই দিনের এই সফরে টিকার খাদ্য বিতরণ কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছেন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী। কক্সবাজারের বালুখালিতে একটি ভাসমান হাসপাতালও উদ্বোধন করেছেন তিনি। স্থানীয় প্রশাসনকে দুটি অ্যাম্বুলেন্সও দিয়েছেন।
রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসা প্রথম বিদেশি সংস্থা টিকা। ২ সেপ্টেম্বর রাখাইনে এক হাজার টন খাদ্য নিয়ে যাত্রা করে তাদের জাহাজ। আগস্টের শেষ নাগাদ সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ায় জাতিসংঘ সাহায্য সংস্থার রাখাইনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে মিয়ানমার সরকার। রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য ও স্বাস্থ্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তুরস্কের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ ও ধর্ম বিষয়ক দফতর।
রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর তুরস্কের উচ্চ পর্যায়ের যেসব নীতিনির্ধারক বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের মধ্যে একজন ইলদিরিম। সেপ্টেম্বরে এসেছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের স্ত্রী এমিনি এরদোয়ান। তার সঙ্গে আসেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কভুসগলু ও সমাজ কল্যাণমন্ত্রী ফাতিমা বেতুল সায়ান কায়া।
চলতি বছর রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রথম নিন্দা জানান এরদোয়ান। তিনিই প্রথম একে ‘জাতিগত নিধন’ আখ্যা দেন। মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির প্রধান হিসেবে বিশ্বের মুসলিম নেতাদের সম্মেলন ডেকে মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার আহ্বান জানান তুর্কি প্রেসিডেন্ট। জাতিসংঘেও বিষয়টি উত্থাপন করেন এরদোয়ান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জানাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তুরস্ক। সুন্নি মুসলিমদের নিপীড়নের হাত থেকে বাঁচাতে বিশ্বব্যাপী তুরস্কের প্রচেষ্টার এটি একটি অংশ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মুসলিম বিশ্বের একজন নেতা হয়ে ওঠার চেষ্টাও করছেন এরদোয়ান।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে তুরস্ক-বাংলাদেশ সম্পর্কে স্থবিরতা তৈরি হয়। ২০১৬ সালের ১১ মে জামায়াতে ইসলামির তৎকালীন প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের নিন্দা জানিয়েছিলেন এরদোয়ান। এ ব্যাপারে ইউরোপীয় নেতারা ‘চোখ বন্ধ করে রেখেছেন’ বলে অভিযোগ করেন তিনি। ঢাকা থেকে তুর্কি রাষ্ট্রদূত দেভরিম ওজতুর্ককে ডেকে নেয় আংকারা। তিন মাস পরে আবার ফিরে আসেন তিনি।
তবে গত বছরের ১৫ জুলাই তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর ওই ঘটনার নিন্দা জানায় ঢাকা। এতে বাংলাদশকে ধন্যবাদ জানান ওজতুর্ক। তুরস্কের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কের অবশ্য ব্যাপারে দুই দেশের পররাষ্ট্র বিভাগ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
এ ব্যাপারে নাম না প্রকাশের শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে, তা ভুলে যেতে চায় বাংলাদেশ ও তুরস্ক। দুই দেশই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রধান মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘প্রধান প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। তাই তুরস্কের কাছে এটা আর বিবেচ্য কোনো বিষয় না।’
খবর৭১/জি: