বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতি বাচ্চুকে খুঁজছে দুদক

0
418

খবর৭১: অর্থ লোপাটের ঘটনায় অবশেষে বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও তার নেতৃত্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে বুধবার দু’জন পর্ষদ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পাশাপাশি বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খোঁজা হচ্ছে। এ মুহূর্তে তিনি কোথায় আছেন, তা নিশ্চিত হতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। তবে আগামী ৪ ডিসেম্বর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ লক্ষ্যে তার বনানীর ডিওএইচএসের বাড়ির ঠিকানায় এ সংক্রান্ত নোটিশ পাঠানো হয়েছে। দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

আরও জানা গেছে, প্রথম দফায় বুধবার বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দুই সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে মামলার তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত দুদকের একটি শক্তিশালী টিম। পর্যায়ক্রমে বাচ্চুসহ অন্য সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তারা হলেন- সাবেক পরিচালনা পর্ষদ সদস্য বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব শ্যাম সুন্দর শিকদার ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কামরুন্নাহার। দুদকের পরিচালক জায়েদ হোসেন খান ও পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম এদিন বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে দু’জনকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় ব্যাংকের ঋণ মঞ্জুরে অনিয়মের বিষয়ে তাদের প্রশ্ন করা হয় বলে জানা গেছে।

পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ও মামলায় আনা অভিযোগের সূত্র ধরে ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ১৮ নভেম্বর নোটিশ ইস্যু করা হয়। নোটিশে তাকে ৪ ডিসেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তিনি দেশে আছেন, নাকি বিদেশে চলে গেছেন তা এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি দুদক। বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে খোঁজা হচ্ছে।

এছাড়া বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য মো. আনোয়ারুল ইসলাম এফসিএমএ ও একেএম কামরুল ইসলাম এবং সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পৃথক নোটিশ দিয়েছে দুদক।

বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির তদন্তে তিন বছরেও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান বা পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ বা আইনের আওতায় আনা হয়নি কেন এমন প্রশ্নে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সম্প্রতি যুগান্তরকে বলেছেন, বাচ্চু ও পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বেসিক ব্যাংক দুর্নীতির ঘটনায় যে যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।

সূত্র জানায়, দুদক চেয়ারম্যানের নির্দেশনা পেয়ে বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি মামলার তদারক কর্মকর্তারা তদন্ত সংশ্লিষ্ট ১০ কর্মকর্তার সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে এ ব্যাপারে নতুন দিকনির্দেশনা দেন। কিভাবে কোথায় পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, সে বিষয়েও একটি গাইডলাইন দেয়া হয় তাদের। সে অনুযায়ী, তদন্ত কর্মকর্তারা প্রথম পর্যায়ে সাবেক পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিশ করেন।

জিজ্ঞাসাবাদে ওই দুই পর্ষদ সদস্যের কাছে কি ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে- জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেসিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ঋণ প্রস্তাবের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে নেতিবাচক সুপারিশ ছিল। নেতিবাচক সুপারিশ থাকার পরও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও পর্ষদ সদস্যরা তা উপেক্ষা করে ঋণ মঞ্জুর করেন। এ বিষয়ে পর্ষদ সদস্যদের প্রশ্ন করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তারা দুদক কর্মকর্তাদের বলেন, সে সময় কাকে ঋণ দেয়া হয়েছে, কিভাবে ঋণের প্রস্তাব এসেছিল এখন মনে নেই। এর বাইরে আর কি বলেছেন তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন ওই কর্মকর্তা।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ঋণ পাওয়া সিনটেক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য ছিল। সেখানে বলা হয়, ওই প্রতিষ্ঠানটিকে ঋণ দেয়ার আগে তারা অন্য কোনো ব্যাংকে ঋণখেলাপি কিনা বা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম করেছে কিনা- সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ রিপোর্ট সংগ্রহ করার সুযোগ থাকলেও শাখাকে সে সুযোগ দেয়া হয়নি কিংবা প্রধান কার্যালয় থেকেও তা সংগ্রহ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি ঋণ পাওয়ার জন্য আবেদনের একদিনের মধ্যে শাখা থেকে সুপারিশ পাঠাতে বলা হয় প্রধান কার্যালয় থেকে। শাখাকে বলা হয়, ‘সিনটেক্সের ঋণ ছাড় করে দাও।’ এভাবেই অন্য প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেয়া ঋণের ক্ষেত্রেও সরাসরি হস্তক্ষেপ করা হয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নামে ঋণ বরাদ্দের জন্য আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গে শাখা থেকে প্রস্তাব পাঠাতে চাপ দিতেন আবদুল হাই বাচ্চু ও ব্যাংকের আরও কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা। বিধান অনুযায়ী, আবেদনের পরপরই ব্যাংকের পক্ষ থেকে আবেদনকারীর বিষয়ে সিআইবি রিপোর্ট নেয়ার কথা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিইআইবি রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়নি। ওপরের চাপের কারণে শাখাও সিআইবি রিপোর্ট সংগ্রহ করার সুযোগ পায়নি। সিআইবি রিপোর্ট ছাড়া ঋণের প্রস্তাব পাঠানোর সময় শাখা থেকে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়কে বলা হয়, ‘সিআইবি রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। এছাড়া ঋণ আবেদনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব সম্পদ (জমি, ফ্ল্যাট কিংবা মিল-কারখানা) বন্ধক রাখার জন্য প্রস্তাব করেছে, সেগুলোও শাখা থেকে মূল্যায়ন করা হয়নি।’ মূলত ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের চাপে শাখার ক্রেডিট কমিটি অনেকটা বাধ্য হয়ে ঋণের প্রস্তাব পাঠায়। আর তাদের প্রস্তাবগুলো পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপনের পর ‘রকেট গতিতে’ ঋণ মঞ্জুর করা হয়। এ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধান কার্যালয়ের অনিয়মের সহযোগী হয়েছে শাখার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও। বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখার তৎকালীন শাখা ম্যানেজার শিপার আহমেদ মামলার একজন আসামি। তিনি কারাগারে আছেন। দুদকের তদন্ত তদারক কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে শিপার বলেছেন, ‘তিনি যা কিছু করেছেন আবদুল হাই বাচ্চুর নির্দেশে করেছেন। আর তার নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছে ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি কাজী ফখরুল ইসলাম।’

দুদকের প্রধান আইন কর্মকর্তা খুরশিদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, আসামি শিপার আহমেদের জামিন শুনানির সময় তার পক্ষে বাচ্চুর বিষয়ে দুদকে দেয়া আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বলেছেন, একজন আসামি দুদকের টিম প্রধানের কাছে লিখিতভাবে যা বলেছেন, তাতেই তো বাচ্চু আসামি হয়ে যান। অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান আরও জানান, পৃথক তিনটি মামলায় জড়িত তিনজন আসামির জামিন শুনানির সময় আদালত পৃথকভাবে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদকে আইনের আওতায় এনে তদন্ত করতে দুদককে বলেছেন। এক আসামির জামিন শুনানির সময় এতবড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় আবদুল হাই বাচ্চুর দায়বদ্ধতা ছিল কিনা এবং এজাহারে তার নাম না থাকার বিষয়টি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আদালত। উচ্চ আদালত থেকে বারবার নির্দেশনা আসার পরিপ্রেক্ষিতেই নড়েচড়ে বসে দুদক।

খুরশিদ আলম খান আরও জানান, বেসিক ব্যাংক মামলার একজন আসামির জামিনের বিষয়ে বুধবারও হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে শুনানি ছিল। আমি আদালতকে দুদকের পক্ষ থেকে নেয়া পদক্ষেপের কথা জানিয়েছি। বাচ্চুসহ পর্ষদ সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের দেয়া নোটিশও আদালতকে দেখিয়েছি। তিনি বলেন, আগামী ২৭ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আরও একটি মামলার শুনানির জন্য দিন ধার্য আছে। ওইদিন আদালত জানতে চাইবেন, বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিষয়ে দুদকের তদন্তের অগ্রগতি কতদূর। আদালতের ওই ধার্য তারিখ সামনে রেখে দুদকের কর্মকর্তারা বেশ কয়েকজন পর্ষদ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদের উদ্যোগ নিয়েছেন। আমি আপিল বিভাগকেও এ বিষয়ে অবহিত করব।

দুদকের দায়ের করা ৫৬টি মামলায় ২ হাজার ৬৫ কোটি টাকা ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেয়া হয় বলে অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে রাজধানীর গুলশান শাখার মাধ্যমে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, শান্তিনগর শাখায় ৩৮৭ কোটি টাকা, প্রধান শাখায় প্রায় ২৪৮ কোটি টাকা এবং দিলকুশা শাখার মাধ্যমে অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে ১৩০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়। যদিও অভিনব পন্থায় অর্থ আত্মসাতের অংশ হিসেবে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ২০১৪ সালের এপ্রিলে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। সে সময় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে বরখাস্ত করা হয়। তবে আবদুল হাই বাচ্চু কিংবা পর্ষদ সদস্যদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে দুদকের দায়ের করা ৫৬টি মামলার কোনো একটিতেও তাদের আসামি করা হয়নি। নিরূপণ করা হয়নি তাদের দায়-দায়িত্ব। ওই ৫৬টি মামলায় বেসিক ব্যাংকের ২৭ জন কর্মকর্তা, ১১ জন সার্ভেয়ার ও ৮১ জন ঋণ গ্রহণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসহ ১২৯ জনকে আসামি করা হয়। এসব মামলা দুদকের ১০ জন কর্মকর্তা তদন্ত করছেন।
খবর৭১/জি:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here