বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়েছেন শেখ হাসিনা, যার নেতৃত্বে টানা চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোট জয় পেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবার পঞ্চমবারের মতো সরকার গঠন করলো।
বিশ্বের নারী সরকারপ্রধানদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি দিন সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, শেখ হাসিনা এরইমধ্যে তাদের শীর্ষে রয়েছেন। আরো পাঁচ বছরের জন্য শপথ নিলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গভবনের দরবার হলে মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়।রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নিয়মানুযায়ী প্রথমে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়ান।
শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন ও গোপনীয়তার শপথ নেন। শপথ পড়ার পর প্রধানমন্ত্রী শপথনামায় সই করেন। প্রধানমন্ত্রী শপথ নেওয়ার পর রাষ্ট্রপতি তাকে অভিনন্দন জানান। এরপর নতুন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীরা পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
রাষ্ট্র পরিচালনায় এবার শেখ হাসিনার সঙ্গী হচ্ছেন ২৫ জন মন্ত্রী, ১১ জন প্রতিমন্ত্রী। গতবারের তিনজন উপমন্ত্রী থাকলেও এবার কোনো উপমন্ত্রী রাখা হয়নি। গতবারের মতো এবারও আওয়ামী লীগের শরিকদের জায়গা হয়নি মন্ত্রিসভায়।
মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যরা শপথ নিতে বঙ্গভবনে ঢুকতে শুরু করে বিকেল চারটার দিক থেকে।
এর আগে, সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে পৌঁছালে অক্টাগোনালে তাকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপ্রধান মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান একসাথে দরবার হলে ঢোকেন। বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহানা এসময় সঙ্গে ছিলেন। দরবার হলে তারা ঢোকার সময় ফ্যান ফেয়ারে রাষ্ট্রপতির আগমনী সুর বাজানো হয়। এরপর ব্যান্ডদল বাজায় জাতীয় সংগীত।
শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেসার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় তিনি।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হাসিনা ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি।
১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়, সে সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান দুই বোন হাসিনা ও রেহানা। পরের ছয় বছর লন্ডন ও দিল্লিতে তাদের নির্বাসিত জীবন কাটে।
১৯৮১ সালের ১৭মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। পাঁচ বছরের মাথায় সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের সময়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বসেন বিরোধী দলীয় নেতার আসনে।
তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯০ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে মিলে একনায়ক এরশাদ সরকারের পতন ঘটায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে গিয়ে আবার বিরোধী দল হয়।
১৯৯৬ সালের ১২ই জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তার সেই সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসেবে পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির কথা বলা হয়।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারিয়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে তৃতীয়বারের মতো বিরোধী দলীয় নেত্রী হন শেখ হাসিনা। ওই সরকারের সময় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর আরও অনেক রাজনীতিবিদের মত শেখ হাসিনাও গ্রেপ্তার হন। দুই বছরের মাথায় ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা।
বিএনপি ও তাদের শরিকদের বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের ভোট হয়, তাতে ২৩১টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ।
সেই সরকারের মেয়াদ শেষে ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত সব দলই অংশ নেয়। ভোটের ফলাফলে ২৯৮ আসনের মধ্যে ২৫৭টিতে জয় পায় আওয়ামী লীগ। জোটগতভাবে তারা পায় ২৮৮ আসন।
২০১৯ সালের তিন জানুয়ারি জাতীয় সংসদে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথের পর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে শেখ হাসিনাকে সংসদ নেতা নির্বাচিত করা হয়।
ওই সরকারের মেয়াদ শেষে গত সাত জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। আবারও আওয়ামী লীগ পায় নিরঙ্কুশ বিজয়।
রোববার অনুষ্ঠিত হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২২২ আসন বা তিন চতুর্থাংশ। বাকী আসনগুলোর মধ্যে স্বতন্ত্র ৬২, জাতীয় পার্টি ১১, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি পেয়েছে ১টি করে আসন।
বৃহস্পতিবার শপথ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পঞ্চম মেয়াদ শুরু করলেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এ পর্যন্ত চার মোট ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। বৃহস্পতিবার তিনি শপথ নিয়েছেন আরও পাঁচ বছরের জন্য।
শ্রীলঙ্কার প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েকে আধুনিক বিশ্বের প্রথম নারী সরকারপ্রধান ছিলেন। সিলন ও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি তিন দফায় ১৭ বছর ২০৮ দিন দায়িত্ব পালন করেন।
ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। ঘাতকের হাতে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত দুই দফায় মোট ১৬ বছর ১৫ দিন তিনি ভারত সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ক্যারিবিয়ার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হওয়া ডোমিনিকা প্রজাতন্ত্রের ইউজিনিয়া চার্লস ক্ষমতায় ছিলেন ১৪ বছর ৩২৮ দিন।
২০০৫ সাল থেকে একটানা ১৩ বছর জার্মানির ক্ষমতায় আছেন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেল। ২০২১ সালে নির্বাচনের পর অবসরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে রেখেছেন তিনি।
আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে একটানা ১২ বছর ৬ দিন দায়িত্ব পালনের পর এলেন জনসন সারলিফ ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা ছাড়েন।