উজ্জ্বল রায়, জেলা প্রতিনিধি নড়াইল থেকে: নড়াইলের মধুমতী নদীর ওপর নির্মিত হচ্ছে ছয় লেনের দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন সেতু।
কালনা পয়েন্টে মধুমতী নদীর ওপর নির্মিত হচ্ছে ছয় লেন সেতু। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেতুটির নির্মাণ শেষ হলে এই জনপদের সঙ্গে রাজধানীর দূরত্ব কমবে ১৬০ কিলোমিটার। ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা সুদৃঢ় হবে। সেতু নির্মাণের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে সংযোগ সড়কের কাজও। কাজ সম্পন্ন হলে বেনাপোল-পদ্মা সেতু-ঢাকা-সিলেট-তামাবিল দিয়ে ‘আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ’ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এতে ভৌগোলিকভাবে বাড়বে নড়াইল জেলার গুরুত্ব। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যতিক্রমী এ সেতুটি দেশের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন সেতুতে পরিণত হবে। ২০২২ সালের মধ্যে এ সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। প্রকল্পটির প্রভাবে এরই মধ্যে শিল্পায়নের ছোঁয়া লেগেছে নড়াইলে। বেনাপোল-যশোর-নড়াইল-ঢাকা সড়কের হাইওয়ের দু’পাশে নড়াইল অংশে জমির দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। ইতোমধ্যে নড়াইল অংশে গড়ে উঠেছে কয়েকটি কলকারখানা। কালনা সেতু বাস্তবায়িত হলে নড়াইল অংশের প্রায় ৩৬ কিলোমিটার এলাকা ইকোনোমিক্যাল জোন হিসেবে পরিণত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সেতুর নড়াইল অংশে মহাসড়কের পাশে ৩০০ একর জমির ওপর একটি ইকোনোমিক্যাল জোন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে এর অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ছয় লেনের এ সেতু হবে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ। চারটি মূল লেনে দ্রুতগতির ও দুটি লেনে কম গতির যানবাহন চলাচল করবে। সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭ দশমিক ১০ মিটার। উভয় পাশে সংযোগ সড়ক হবে ৪ দশমিক ২৭৩ কিলোমিটার, যার প্রস্থ ৩০ দশমিক ৫০ মিটার। সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। জাপান ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। জাপানের টেককেন করপোরেশন, ওয়াইবিসি ও বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্প পরিচালক কে এম আতিকুল হকের দাবি, ‘বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ব্যতিক্রম ছয় লেনের সেতু হবে এটি। এমন সেতু দেশে এই প্রথম।’ সরেজমিনে দেখা গেছে, মধুমতী নদীর কালনা ফেরিঘাটের দক্ষিণে নির্মিত হচ্ছে সেতুটি। নদীর পূর্বপাড়ে সংযোগ সড়ক নির্মাণের বালু ভরাটের কাজ চলছে। কয়েকজন জাপানি প্রকৌশলী সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান করছেন। প্রকৌশলীরা জানান, সব মিলিয়ে ৩০০ জন এখানে কাজ করছেন। সেতুর উপ-প্রকল্প ব্যবস্থাপক সৈয়দ গিয়াস উদ্দিন জানান, ২০১৮ সালের ২৪ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কার্যাদেশ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর কার্যাদেশ দেয়া হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সময় বেধে দেয়া হয় তিন বছর। সেই অনুসারে, ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়ার কথা। তিনি আরও জানান, গত বছর ২৯ মার্চ থেকে মূল সেতুর পাইলিং শুরু হয়েছে। সেতুতে মোট ২৭২টি পাইলিংয়ের কাজ আছে। মোট ১৪টি পিলারের ওপর বসানো হবে ১৩টি স্প্যান। ৫টি পিলার হবে নদীর মধ্যে। এর জন্য সেখানে লাগবে ১২৪টি পাইলিং। গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘সংযোগ সড়কের জমি বুঝে পেতে দেরি হওয়ায় সেটির কাজ শুরু হয়েছে দেরিতে। এজন্য একটু পিছিয়ে আছি। তাছাড়া করোনার কারণে কাজের কিছু ধীর গতি হয়েছে। জাপানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কিছু টেকনিশিয়ান আসতে পারছেন না। সেতুটির কাজ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। বর্তমানে সেতুটির ৫০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। কাজের সময় বৃদ্ধি করা হবে।’ তবে ২০২২ সালে সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই কর্মকর্তা। সওজ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সেতু চালু হলে ঢাকার সঙ্গে বেনাপোল স্থলবন্দর, সাতক্ষীরা, যশোর, নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। এতে সময় ও জ্বালানি তেলের সাশ্রয় হবে। নড়াইল জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি সরদার আলমগীর হোসেন বলেন, কালনাঘাট দিয়ে বেনাপোল-ঢাকা সড়কের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার, যশোর-ঢাকা ১৬০ কিলোমিটার, নড়াইল-ঢাকা ১২৬ কিলোমিটার, খুলনা-ঢাকা ১৯৫ কিলোমিটার। অথচ দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে ঢাকা যেতে এসব সড়কে ৩০০ থেকে ৪৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করতে হয়। সেতুটি চালু হলে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার দূরত্ব কমবে ১৬০ থেকে ২০০ কিলোমিটার লোহাগড়া বাজারের ব্যবসায়ী রহমান শেখ জানান, এ সেতু নির্মিত হলে কৃষি পরিবহন ও বিপণন সহজ হবে। চাঙ্গা হবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর সুফল পাবেন খুলনা বিভাগ ও আশেপাশের অন্তত ১৫টি জেলার কৃষক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীর ব্যবসায়ী সুধীর বিশ্বাস (৪২) বলেন, সেতুর অভাবে কালনা ফেরিঘাটে এসে আমাদের এক থেকে দুই ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। মালামাল পরিবহনে সমস্যা হয়। যানবাহনের ব্যাপক চাপ থাকা সত্তে¡ও কখনো একটি, আবার কখনো দু’টি ফেরিতে যানবাহন পারাপার করা হয়। কালনাঘাটের ফেরিচালকরা জানান, ঘাট দিয়ে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ গাড়ি পারাপার হয়। মাঝেমাঝে ফেরি বিকল হলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। নড়াইলের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. ফকরুল হাসান বলেন, নড়াইল সম্ভাবনাময় জেলা। কালনা সেতু চালু হলে এলাকার চিত্র পাল্টে যাবে। বিষয়টি অনুধাবন করে সরকার নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় ৩০০ একর জমি নিয়ে একটি ইকোনোমিক্যাল জোন করার পরিকল্পনা করছে। ইতোমধ্যে প্রাধানমন্ত্রী ইকোনোমিক্যাল জোনের অনুমোদন দিয়েছেন। এছাড়া হাইওয়ের পাশে ধোপাখোলা এলাকায় বিসিক শিল্পনগরী করার জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।