খবর৭১ঃ ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা মিউকরমাইকোসিস নিয়ে অহেতুক ভয় না পেতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য শারফুদ্দিন আহমেদ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য জানিয়ে তিনি আশ্বস্ত করেছেন, ভারতের মতো বাংলাদেশে এটি মহামারির আকার ধারণ করবে না।
‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা বিষয়ক গাইডলাইনের প্রকাশনা’ উপলক্ষে বুধবার বিএসএমএমইউর ডা. মিল্টন হলে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিএসএমএমইউর উপাচার্য বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তি করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে থেকে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা আবশ্যক। সময় নষ্ট না করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ছত্রাকবিরোধী ওষুধ বা অ্যান্টিফাঙ্গাল ড্রাগ জরুরিভাবে প্রয়োগ করতে হবে। পাশিপাশি ঝুঁকিসমূহ যেমন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে।’
অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘প্রয়োজনে আক্রান্ত অঙ্গে সার্জারি করতে হতে পারে বা কোনো কোনো সময়ে তা কেটে ফেলে দিয়ে জীবন রক্ষা করতে হতে পারে। যেমন রাইনো- অরবিটাল-সেরেব্রাল সংক্রমণে নাক, সাইনাস বা চক্ষুকোটরের অপারেশন, আক্রান্ত অংশ অপসারণ, চক্ষু অপসারণ, এক্সেন্টারেশন ও ইন্ট্রাক্র্যানিয়াল সার্জারি অন্যতম।’
বিএসএমএমইউর ভিসি বলেন, ‘কোভিড মহামারির সঙ্গে ভারতের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের প্রাদুর্ভাবের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে কয়েকজন রোগী পাওয়া গেলেও এই মুহূর্তে ভারতের মতো মহামারির আশংকা নেই।’
ভিসি জানান, বিএসএমএমইউর বর্তমান প্রশাসন সব চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের নিয়ে কোভিডের মোকাবিলায়, বিশেষ করে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। আইসিইউ ও বেড সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়িয়ে, হাইফ্লো অক্সিজেনের সরবরাহ সম্প্রসারিত করে ও পূর্ণ উদ্যমে ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমে কোভিডের সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নিয়েও সরকার, চিকিৎসক সমাজ, সাংবাদিক ও জনগণকে সঠিক ধারণা ও করণীয় সম্পর্কে সচেতন করতে আজ এই গাইডলাইন প্রকাশ করা হলো।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বিশেষ ধরনের অনুবীক্ষণিক ছত্রাকের সংক্রমণজনিত বিভিন্ন রোগকে বোঝায়। এর মধ্যে রাইজোপাস প্রজাতি হল সবচাইতে বেশি দায়ী, তবে অন্যান্য জীবাণু যেমন মিউকর, কানিংহামেলা, অ্যাফোফিজোমাইসেস, লিচথিমিয়া, সাকসেনিয়া, রাইজোমুকর এবং অন্যান্য প্রজাতিও এই রোগের কারণ। এই ছত্রাক সর্বব্যাপী-মাটি পানি ও বাতাসে ছড়িয়ে থাকলেও সংক্রমণ ক্ষমতা এতই কম যে, এক লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র এক থেকে দুজনের বেড়ে যেতে পারে- যেটা এক লাখে ২০-৩০ জন হতে পারে। এই রোগ ছোঁয়াচে নয়। বহু আগে থেকেই এই রোগের কথা জানা থাকলেও ইদানীং কোভিড মহামারিতে ভারতে এর প্রকোপ দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বিশেষত কিটো অ্যাসিডোসিস আক্রান্ত রোগীরা, ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী, অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা, অত্যাধিক মাত্রায় বা অপ্রয়োজনীয় স্টেরয়েড গ্রহণ করা, কিডনি বা অন্য অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা রোগী এবং চরম অপুষ্টিজনিত রোগী, চামড়ার গভীর ক্ষত ও পোড়া ঘায়েও এই রোগ হতে দেখা যায়, কোভিড ভাইরাসে দীর্ঘমেয়াদে আক্রান্ত বা চিকিৎসাধীন রোগী এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, মিউকর ছত্রাকের হাইফাগুলো মানুষের রক্তনালীগুলিতে আক্রমণ করে, যা থেকে থ্রম্বোসিস ও টিস্যু ইনফার্কশন, নেক্রোসিস এবং পরিশেষে গ্যাংরিন তৈরি করে। সুস্থ মানুষের রক্তের শ্বেতরক্তকণিকা বা নিউট্রোফিল এই ছত্রাকের বিরুদ্ধে মূল প্রতিরক্ষার কাজ করে থাকে। সুতরাং, নিউট্রোপেনিয়া বা নিউট্রোফিল কর্মহীনতায় (যেমন, ডায়াবেটিস, স্টেরয়েড ব্যবহার) বা এইডস আক্রান্ত ব্যক্তিরা সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন।
আক্রান্ত অঙ্গের ওপর ভিত্তি করে মিউকরমাইকোসিস রোগটি ছয়টি ধরনের হলেও রাইনো-অরবিটাল-সেরেব্রাল রোগ নাক, নাকের ও কপালের সাইনাস, চোখ ও ব্রেইন বা মস্তিষ্কের সংক্রমণ করে বলে এটাই সবচাইতে বিপদজনক। তাছাড়া ফুসফুসীয়, আন্ত্রিক, ত্বকীয় সংক্রমণও হতে পারে। আক্রান্ত অংশ আর নাকের শ্লেষ্মা, কফ, চামড়া ও চোখ কালো রং ধারণ করে বলে একে কালো ছত্রাক নামে ডাকা হয়। আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত এবং সঠিক চিকিৎসা না করতে পারলে ৫০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ রোগী মৃত্যুবরণ করে থাকে। আর সংক্রমণের মৃত্যুর হার ১০০ শতাংশের কাছাকাছি।
সংবাদ সম্মেলনে বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) মুহাম্মদ রফিকুল আলম, উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) জাহিদ হোসেন, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) একেএম মোশাররফ হোসেন, কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, প্রক্টর হাবিবুর রহমান দুলাল, রেজিস্ট্রার এবিএম আব্দুল হান্নান, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান আহমেদ আবু সালেহ, নাক কান গলা বিভাগের চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী, এ্যানেসথেশিয়া বিভাগের চেয়ারম্যান এ কে এম আখতারুজ্জামান, চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাফর খালেদ, ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান সোহেল মাহমুদ আরাফাত, মিডিয়া সেল কর্মকর্তা সহকারী অধ্যাপক এসএম ইয়ার-ই-মাহাবুব উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে একই স্থানে ইনস্টিটিউশনাল রিভিউ বোর্ডের (আইআরবি) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘ট্রেনিং অফ ট্রেইনার্স অন রিসার্চ অ্যান্ড ইথিকস’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী কর্মশালার সমাপনী অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে সনদ বিতরণ করেন শারফুদ্দিন আহমেদ। সভাপতিত্ব করেন আইআরবির সভাপতি ও বিএসএমএমইউর উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) একেএম মোশাররফ হোসেন।