খবর৭১ঃ দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি, ভারত থেকে হঠাৎ করেই অক্সিজেন আসা বন্ধ ও হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের চাহিদা বাড়ায় শিল্প প্রতিষ্ঠানে অক্সিজেনের ব্যবহার ও সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বিস্ফোরক পরিদফতর।
এ অবস্থায় প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ এক স্মারকে শিল্পে ব্যবহারের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে বিকল্প হিসেবে সিঙ্গাপুর থেকে অক্সিজেন আমদানির পরিকল্পনাও রয়েছে, যা সময়সাপেক্ষ।
দেশের মোট অক্সিজেন চাহিদার বড় অংশই ভারত থেকে আসে। কিন্তু দেশটি করোনায় বিপর্যস্ত হওয়ায় অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। আবার দেশে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন হাসপাতালে এরই মধ্যে সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্মারকে বিস্ফোরক পরিদর্শক বলেন, করোনাভাইরাসজনিত রোগের সংক্রমণ সম্প্রতি দ্রুত বাড়ছে। দেশের হাসপাতাল/ক্লিনিকে করোনাভাইরাসে মারাত্মক আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন হ্রাসের কারণে দ্রুত মেডিকেল গ্রেডের অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। এই পরিস্থিতিতে হাসপাতাল/ক্লিনিকে চাহিদা অনুসারে মেডিকেল অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন বৃদ্ধি এবং হাসপাতালে নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্সিজেন সরবরাহ বজায় রাখা প্রয়োজন। তাই দেশে করোনা সংক্রমণ চলাকালীন শিল্পে অক্সিজেনের ব্যবহার বন্ধ রেখে শুধু হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহের নির্দেশনা প্রদান করা হলো।
চলতি মাসের শুরুতে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সময় দিনে সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২২০ টন পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা হতো। এর মধ্যে ১০০ টন আসত পাশের দেশ ভারত থেকে। বাকিটা দেশেই উৎপাদিত হয়েছে। ২১ এপ্রিলের পর ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই দেশে অক্সিজেনের সরবরাহ কমেছে। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, করোনা রোগী কমে আসায় অক্সিজেনের চাহিদাও কমে গেছে। কিন্তু রোগী বাড়লে বড় বিপদের শঙ্কা আছে।
লিন্ডে বাংলাদেশ, স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড, ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড, ডিআর ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও মেসার্স বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস লিমিটেড এই পাঁচটি অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে নতুন করে শিল্প অক্সিজেন তৈরির প্রতিষ্ঠান এ কে অক্সিজেন, ইউনিয়ন অক্সিজেন ও আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং মিল থেকে মেডিকেল অক্সিজেন তৈরির সাময়িক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এরা কিছু কিছু করে অক্সিজেন সরবরাহ করছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, করোনার সংক্রমণের আগে দেশের স্বাস্থ্য খাতে অক্সিজেনের চাহিদা ছিল দিনে ১০০ থেকে ১২০ টন। ওই সময় আমদানির প্রয়োজন হতো না। করোনার সংক্রমণ শুরু হলে চাহিদা বাড়তে থাকে। শুরু হয় ভারত থেকে আমদানি। চলতি এপ্রিলের শুরুতে দিনে চাহিদা সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ২২০ টনে পৌঁছায়। এখন এটি কমে ১৪০ থেকে ১৫০ টনে দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়নি।
লিন্ডে বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (মানব সম্পদ) ও মুখপাত্র সাইকা মাজেদ বলেন, চাহিদা তো আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। গত ছয় সপ্তাহে চাহিদা প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। আর গত এক বছরে যদি বলি সেটা তিনগুণের বেশি বেড়েছে। এই চাহিদা মেটাতে আমরা এখন শিল্পজাত অক্সিজেনের চেয়ে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
তিনি জানান, আমরা মূলত তরল অক্সিজেনকেই বেশি অগ্রাধিকার দেই। আইসিইউতে এ ধরনের অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন সরকারি হাসপাতাল ও বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলো আমাদের কাছে যে চাহিদা দিচ্ছে, এখন পর্যন্ত সেটা দিতে পারছি। এই মুহূর্তে যেহেতু তাদের চাহিদা একটু বেশি, আমরা শিল্প কারখানার অক্সিজেন বন্ধ করে দিয়ে তাদেরকে দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত চলছে, কিন্তু ভারতের মতো যদি অবস্থা হয়, তাহলে আমাদের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে।
কেমন মজুদ আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মজুদ আছে অল্পকিছু অক্সিজেন। মজুদ তো আসলে বেশি রাখা যায় না, এটা তরল জিনিস। এটা তৈরি করে ট্যাংকারে রাখতে হয়, সেখান থেকে তরলীভূত হয়ে চলে যায়। ফলে তেমন বেশি মজুদ করে রাখার সুযোগ নেই। এটা চলমান প্রক্রিয়া, উৎপাদন হবে আর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সেটা হাসপাতালে চলে যাবে। তারপরও জরুরি অবস্থা বিবেচনায় কিছু মজুদ করে রাখা হয়।
ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ জানান, আগের তুলনায় অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে অনেকগুণ। সব সময় সিরিয়াল লেগে আছে। কারণ ৯ দশমিক ৮ কিউবিক মিটার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটা সিলিন্ডার স্কেলিং করতে ৫০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা সময় লাগে। আমাদের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। যেহেতু এটা আনলিমিটেড নয়। আমরা দিনে সর্বোচ্চ ২৮ হাজার ৮৮০ কিউবিক মিটার অক্সিজেন রিফিল করতে পারি।
তিনি বলেন, এক সপ্তাহ আগে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি চাহিদা ছিল। এখন ৩০ শতাংশের মতো কমেছে। তবে সবমিলিয়ে এখন যে চাহিদা আছে, তা মেটানো সম্ভব। কিন্তু যদি সংক্রমণ বাড়ে, তাহলে পরিস্থিতি ভারতের মতো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যা নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
তিনি আরও বলেন, মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা অনেক বেড়ে যাওয়ায় ২০ দিন আগে থেকেই ইসলাম অক্সিজেন শিল্পজাত অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এর পুরোটাই এখন মেডিকেল অক্সিজেন। দৈনিক ২৮ হাজার ৮০০ কিউবিক মিটার অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতা আমাদের আছে। এরমধ্যে আমরা নিয়মিত ২১/২২ বা ২৩ হাজার কিউবিক মিটারের মতো উৎপাদন করছি।
স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেডের ঢাকা ডিপোর ডিসট্রিবিউশন অফিসার গৌতম অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিলের চাপ বাড়ার কথা জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্পেকট্রা অক্সিজেনের একজন কর্মকর্তা জানান, স্পেকট্রা দৈনিক ২৫ টন মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করে। তিনি বলেন, ‘এখন চাহিদা বেড়ে গেছে। আগে আমাদের ৬০ শতাংশ যন্ত্র মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের কাজ করত। এখন সবগুলো যন্ত্র ২৪ ঘণ্টা শুধু মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদনের কাজেই ব্যবহার করা হয়।’