খবর৭১ঃ করোনাভাইরাস মহামারির এই সময়ে স্বাস্থ্য খাত ও সেবায় অনিয়ম এবং দায়িত্ব পালনে অবহেলার অভিযোগ এনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অপসারণের দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদে।
মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বিরোধী দলের একাধিক সাংসদ স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা তুলে ধরেন। এসময় তারা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেন। কেউ কেউ মন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ারও দাবি তোলেন।
তবে, এসব সমালোচনাকে আগ্রাহ্য করে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে ‘পজিটিভ’ খবর দেওয়ার জন্য গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তা না হলে তরুণ, বয়স্ক, চিকিৎসকসহ তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বেন- বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘দুঃখের বিষয়, সাবেক-বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর যারই হোক, অসুখ হলে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। প্রধানমন্ত্রী, আপনি একটা নির্দেশনা দেন। এমপি, মন্ত্রী, সরকারি কর্মকর্তা বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করবেন। জরুরি প্রয়োজন না হলে বিদেশ যাবে না। তাহলে উন্নতি হবে।’
মুজিবুল হক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ২৪ ঘণ্টা খবর রাখছেন। কিন্তু আপনার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর তো একবার ঢাকা মেডিকেলে, একবার সোহরাওয়ার্দী, একবার জাতীয় হৃদ্রোগ হাসপাতালে কিংবা পিজিতে ভিজিট করা উচিত ছিল। আমি সেখানে এমনিতেই গেছি। ডাক্তাররা বলছেন, এখানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এলে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সমালোচনা করে জাতীয় পার্টির এই সাংসদ বলেন, ‘৩ মার্চ স্বাস্থ্যের মহাপরিচালক বললেন, বাংলাদেশের যে আর্দ্রতা, গরম, করোনা বাংলাদেশে আসতে আসতে মরে যাবে। কোনো সমস্যা হবে না। আবার ২৫ জুন সেই একই ব্যক্তি বললেন, করোনা দুই থেকে তিন বছরে যাবে না। এগুলো দেখা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, থানা-উপজেলায় প্রথমে খুবই নিম্নমানের পিপিই দেওয়া হলো। তার এলাকায় এগুলো পরে ডাক্তার-নার্স আক্রান্ত হলেন। যারা আক্রান্ত হলেন, মারা গেলেন কে জবাব দেবে?
বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘করোনায় মারা যাবে। সারা পৃথিবীতে যাচ্ছে। কিন্তু কতটুকু চিকিৎসা দিতে পারছি, এটাই বড় প্রশ্ন? দেশে সেই চিকিৎসাটাই নেই।’ বাংলাদেশে সংক্রমণ হার অনেক বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নমুনা পরীক্ষার ২৩ শতাংশ পজিটিভ আসছে। তাও ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে ১০ থেকে ১৫ দিন পর। এতে ঝুঁকি আরও বাড়ছে।’ তিনি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট বাড়ানোর দাবি জানান।
জাতীয় পার্টির সাংসদ শামীম হায়দার পাটোয়ারি বলেন, বেসরকারি অনেক হাসপাতালে ডাক্তাররা ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। বেতন পান ২০ হাজার টাকা। বেসরকারি হাসপাতালগুলোর লাগাম টানতে না পারলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দাঁড় করানো যাবে না।
সুনামগঞ্জে নিজ নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের বরাত দিয়ে জাপার আরেক সাংসদ পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘এই যে আইসিইউ, অক্সিজেন ও চিকিৎসা নেই। গ্রামের বাজারের লোকজন তাকে সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সরিয়ে দেওয়ার কথা তোলার অনুরোধ করেছেন। গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব মতিয়া চৌধুরীর হাতে দেওয়ার কথা বলেছেন।’
জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার মন্ত্রণালয়ের নেওয়া নানা পদক্ষেপ তুলে ধরেন এবং নিজে মাঠে আছেন বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় মিডিয়া বলে, আমরা এখন ঘরে বসে আছি। মিডিয়া যদি সব সময় শুধু মৃত্যুর খবর, দুঃসংবাদ দিতে থাকে, তাহলে আমাদের যারা তরুণ জেনারেশন আছে, তারা কিন্তু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে। আমাদের বয়স্করাও অসুস্থ হয়ে যাবে। আমরাও যারা আছি, তারাও অসুস্থ হয়ে যাব। তাই আমাদের একটু পজিটিভলি কথা বলতে হবে।’
নিজের ভূমিকার সপক্ষে বলতে গিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘পাঁচ মাস কিন্তু আমরাই মাঠে আছি। প্রতিটি হাসপাতাল যে আমরা যাইনি, এ কথাটা সঠিক নয়। বসুন্ধরা কীভাবে বানিয়েছি। ২৫ দিনে বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টার, হাসপাতাল করা হয়েছে। ডাক্তার-নার্স আমরা যারা কাজ করি, তাদের অনুপ্রাণিত করলে তারা আরও কাজ ভালো করবে। ৫০ জন ডাক্তার-নার্স মারা গেছেন। সব সময়ই যদি সমালোচনা করি, তাহলে সঠিক হবে না।’
সফটওয়্যার ক্রয়ে দুর্নীতি ও ডাক্তারদের থাকা-খাওয়ার জন্য অস্বাভাবিক ব্যয়ের ব্যাখ্যা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, সফটওয়্যার ক্রয় হয়নি। এটা প্রাক্কলন। বিশ্বব্যাংকের টাকা। তারাই ক্রয় করবে।
করোনায় সাফল্য আছে দাবি করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘করোনায় সোয়া লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে। দোকানপাট চালু হয়েছে। জীবন-জীবিকার বিষয় আছে। শিল্পকারখানা চালু হয়েছে। ঈদে আমরা বাড়ি যাই। এ জন্য সংক্রমণের হার একটু বেড়েছে। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যা তো কম। আমরা আশা করি, এই সংক্রমণ হারও কমবে, যখন মানুষ বেশি করে মাস্ক পরবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় চলবে এবং মানুষ জানবে যে কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত করা যায়। এই বিষয়গুলো আগে জানত না। এখন জানে।’
বর্তমানে সরকারের স্বাস্থ্য খাতে অবদান তুলে ধরে জাহিদ মালেক বলেন, শেখ হাসিনার সরকার ক্যানসার ইনস্টিটিউট, চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮টি মেডিকেল কলেজ ও আড়াই শ নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। হাসপাতালে ২৫ হাজার শয্যা বাড়ানো হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ভ্যাকসিন হিরো হয়েছেন। মাদার অব হিউম্যানিটি, সাউথ সাউথ পুরস্কার পেয়েছেন। সব স্বাস্থ্যের কারণে হয়েছেন। আমাদের এখন গড় আয়ু ৭৩ বছর। আর অল্প দিন হলেই এটা আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে ধরে ফেলব। তাদের এখন গড় আয়ু ৭৮ বছর। কাজেই এটা স্বাস্থ্যের একটা বড় অবদান।’
সবার সহযোগিতা পেলে অল্প দিনের মধ্যেই কোভিড-১৯ থেকে ছাড় পাওয়া যাবে বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান।
তিনি বলেন, ‘কোভিড চলে গেলে সাধারণ গতিতে এগিয়ে যাবে দেশ। প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ৮.২, যেটা ধরা আছে তা পারব। তবে কোভিড ভাইরাস যদি না যায়, যদি আমরা সব সময় মৃত্যুর ঝুঁকিতে, ভয়ে থাকি, তাহলে কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ভালো হবে না।’