খবর৭১ঃ
চাকরিস্থায়ীকরণের দাবিতে তিনদিন ধরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন বারডেম জেনারেল হাসপাতালের শতাধিক চিকিৎসক। মঙ্গলবারও তারা আবেদনপত্র নিয়ে আন্দোলন করে যাচ্ছিলেন।
তিনদিন ধরে আন্দোলন চললেও এর কোনো সুরাহা মেলেনি। বরং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক নোটিশের মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলনকারীদের কাজে যোগ দেয়ার কথা বলেছে। অপরদিকে চিকিৎসকদের সংগঠনগুলো মনে করছে, অস্থায়ীভাবে চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়টি যুক্তিযুক্ত নয়। নিশ্চিত করা উচিত চিকিৎসকদের সুরক্ষার বিষয়টিও।
গত রবিবার থেকে চাকরিস্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলনে নামে রাজধানীর শাহবাগের বারডেম হাসপাতালের আরএমও, সিএ, এম (অস্থায়ী) পদের চিকিৎসকরা।
আন্দোলনাকারীরা জানান, করোনাভাইরাসের শুরু থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়মের কারণে এমন পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিয়ে চিকিৎসকের কোনো ধরণের সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে পিপিই দেয়া হলেও তা বারবার ধুয়ে ব্যবহারের জন্য বলা হয়। এমন অবস্থায় বেশ কয়েকজন চিকিৎসক কোভিড-১৯ আক্রান্ত হন। আক্রান্ত চিকিৎসকদের চিকিৎসা না দিয়ে তাদেরকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারী চিকিৎসক মো. সজীব বলেন, ‘আমরা প্রথমে আমাদের নিরাপত্তা বিষয়ে পাঁচটি দাবি জানিয়েছিলাম। যা কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দেয়নি। ফলে আমরা একটি দাবিতে রয়েছি। সেটি হচ্ছে, আমরা আমাদের চাকরির নিশ্চয়তা চাই। এ দাবিতে আমরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছি।‘
তিনি আরও বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ একটি নোটিশ দিয়েছে। তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমাদেরকে কাজে যোগ দিতে বলেছে। নইলে আমাদের ট্রেনিং অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এবিষয়ে আমরা আমাদের উত্তর জানিয়েছে কর্তৃপক্ষের কাছে। একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছি।‘
হাসপাতালটির মহাপরিচালক বরবার আন্দোলনকারীদের আবেদনপত্রে বলা হয়, ‘আপনার পত্র দিয়ে আপনি আমাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্রেনিংয়ে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। যে সারকুলার দিয়ে আমাকে আরএমও পদে যোগদানের জন্য আবেদন করতে বলা হয়েছিল সেখানে আরএমও পদটি যে ট্রেনিং পদ, তার কোনো উল্লেখ ছিল না। যা প্রতারণামূলক।‘
‘আরএমও পদে যোগ দেয়ার সময় নিয়োগপত্রে ট্রেনিং শব্দটি যুক্ত করা হয়, এটাও প্রতারণামূলক। তারপরেও চিকিৎসকরা উচ্চশিক্ষায় কাজে লাগবে ভেবে এই পদটিতে যোগ দেন। আমিও দিয়েছিলাম। অথচ আমাকে ট্রেনিং দেয়ার নামে কাজ করানো হয়েছে ও শ্রমের শোষণ করা হয়েছে। এই পদটিতে অনেকেই ৪ বছর ও কেউ কেউ তার অধিককাল কর্মরত থাকলেও তাদের এখনো ট্রেনিং পদ হিসেবে বিবেচনা করা অন্যায়। এখানে বেতন ভাতা বৃদ্ধি করার নিয়ম নাই। উল্টা আমার বেতন ভাতার একটি অংশ কর্তন করা হয়েছে কোন নোটিশ না দিয়ে। যার যুক্তিসংগত কারণ নাই। এটা যদি ট্রেনিং পোস্ট হয়ে থাকে তবে হাসপাতালের লাভ ক্ষতি বা আয় ব্যয়ের সাথে এর কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কারণ প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য রোগীর সংখ্যা বা রোগী হতে প্রাপ্ত আয় বিবেচ্য নয়। আমি আমার কাজ করলেই সম্মানি পাওয়ার কথা। কাজের শর্তে সম্মানী ও ভাতাদি কর্তনের কোন ধারা নাই্।‘
‘৬ মাস পরপর কাজের মূল্যায়ন ও ট্রেনিং বাতিল করার শর্ত দিয়ে আমাকে অন্য কোন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বা তার কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হতে বাধা প্রদান সুস্পষ্ট অধিকার লংঘণ। আমি যেহেতু আপনাদের পূর্ণকালীন স্থায়ী কর্মকর্তা নই এবং এখানে কেবল প্রশিক্ষনের নিমিত্তে আপনারা আমাকে নিযুক্ত করেছেন তাই আপনারা আমার অন্য কোনো ধরনের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানে মালিকানা বা বিনিয়োগে বাধা দিতে পারেন না। বারডেমে প্রশিক্ষণকালীন সময়ে আমাকে ঢাকার বাইরে মেডিকেল ক্যাম্প করতেও পাঠাতে পারেন না। কারণ মেডিকেল ক্যাম্প কোনো প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ড নয় এবং এই ক্যাম্পে যাতায়াত থাকা খাওয়া সংক্রান্ত কোনো বক্তব্য আপনাদের নির্বাচনপত্রে ছিল না। একই নির্বাচনপত্রের অধীনে যদি আপনারা আমাকে ঢাকার বাইরে পাঠালে যাতায়াত ও থাকা খাওয়া দেন, তবে আপনারা ঢাকাতেও এটি দিতে যৌক্তিক ভাবে বাধ্য। কারণ উভয় স্থানেই প্রশিক্ষন হলে উভয় স্থানে আমাকে একই সুবিধাও দেয়া উচিত। অথচ সেটাও কখনো করেন নাই।‘
‘একটি নির্বাচনপত্রে নোটিস পিরিয়ড উভয় পক্ষের জন্য সমান হতে হয়। আপনারা আমার কাছ হতে একমাসের নোটিস দাবি করেছেন অথবা একমাসের সম্মানি পরিশোধ করে সাথে সাথে অব্যাহতি নিতে বলেছেন। অথচ আমার নির্বাচনপত্র রদ করলে তার জন্য আপনারা কোনো নোটিস দেবেন না। এটা দেশের আইনের সুস্পষ্ট লংঘন। যা এই পুরো নির্বাচনপত্রে আপনাদের দুরভিসন্ধির আরেকটি প্রমাণ। কোভিডকালীন সময়ে আপনারা আমাকে কোন প্রতিরক্ষা সামগ্রী প্রদান না করে আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের জীবন বিপন্ন করেছেন। বেআইনিভাবে সম্মানী কর্তন করেছেন। শুধু তাই নয় এখনো আমার সম্মানী পরিশোধ না করে ও প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা না করে আমাকে কাজ করতে নির্দেশ দিচ্ছেন। এটি অমানবিক, বেআইনী ও চিকিৎসকদের অধিকারের লংঘন।‘
‘বারডেমের যে ভবনটিতে আমরা কাজ করি এই ভবনটির জায়গাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর দান ও এই প্রতিষ্ঠানটি অধ্যাপক মো. ইব্রাহিমের স্বপ্ন। এখানে বসে তরুণ ডাক্তাদের সঙ্গে ট্রেনিংয়ের নামে প্রতারণা ও অনিরাপদ অব্স্থায় কোভিডকালীন দায়িত্ত্ব পালনে বাধ্য করার হীন চেষ্টা করা ছাড়াও, আপনারা বেআইনিভাবে নিয়ম লংঘন করে আমার বেতন ভাতা কর্তন করেছেন। এ ধরনের কর্মকাণ্ড উপরোল্লিখিত মহান ব্যক্তিদের নাম, সুনাম ও বারডেমের মতো প্রতিষ্ঠানের সুনামের জন্য ক্ষতিকর। একই কারণে এই কাজগুলি আমার নির্বাচনপত্রের ধারা অনুযায়ী বারডেমের স্বার্থবিরোধী কাজ। আপনারা নিজেরা প্রতিষ্ঠানের সুনাম লংঘন করছেন ও অন্যকে আদেশ নির্দেশ দিচ্ছেন যা অনৈতিক বা আনএথিকাল ও বিবেকহীনতার পরিচায়ক। আপনার চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে অনতিবিলম্বে বিরাজমান সকল অনিয়ম দূর করে আমাকে কাজ করার নিরাপদ পরিবেশ দিতে ও সঠিক সম্মানি দিতে অনুরোধ করছি। অন্যথায় এই পত্রটিকে নোটিশ হিসেবে বিবেচনা করে কেন আপনার ও আপনার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমি মামলা করবো না সেটার উত্তর দেবেন বলে আশা করছি।‘
এবিষয়ে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস এন্ড রেসপনসিবিলিটিজের (এফডিএসআর) যুগ্ম মহাসচিব ডা. রাহাত আনোয়ার চৌধুরী বলেন, ‘এই পোস্টগুলোর কর্মকাঠানো যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন যে বাংলাদেশে চিকিৎসকদের বিভিন্ন জায়গায় চাকরির যে নিয়মনীতি আছে তার সঙ্গে যায় না। তাদেরকে এক ধরনের শোষণ করা হচ্ছে বলে আমরা মনে করি। ৪ বছর ট্রেনিংয়ে যাদের থাকার কথা, ৪ বছর পরেও অনেকে আছে, যাদেরকে তারা স্থায়ী করেনি। তারা যাদেরকে অস্থায়ী বলছে, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কিন্তু এবিষয়টি উল্লেখ ছিল না। এটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে তাদের যে ন্যায্য দাবিগুলো, তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া হয় নাই। রোগী সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে তাদেরকে পিপিই দেয়া হয়নি। চিকিৎসকদের করোনা পরিক্ষা করানো হয়নি। এটা কিন্তু এক ধরণের শোষণ। বারডেম যাদেরকে ট্রেইনি হিসেবে নেন, ওনাদের জন্য তাদের একটা আলাদা কাঠামো করা উচিত। যেটা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে আছে। ওনারা সরকারেরটাও অনুসরণ করতে পারে। অন্যান্য জায়গাতেও ট্রেইনিরাও একটা নিয়মের মধ্যেউ কাজ করে। কিন্তু বারডেমের এটা একটু শোষণমূলক। এটাই হচ্ছে সমস্যা।‘
ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজের (এফডিএসআর) এ আন্দোলনকে সমর্থন দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ৪৬ হাজার চিকিৎসকদের এই সংগঠনের মহাসচিব ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন।
তিনি বলেন, ‘একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চাকরি দেয়ার বিষয়টির মধ্যে একটা বৈষম্য দেখা গেছে। যারা কাজ করছে তারা ট্রেইনি হোক আর যাই হোক, তাদের সুরক্ষার বিষয়টা নিশ্চিত না করা, সেটা তো দুঃখজনক। বিশেষ করে যারা আক্রান্ত হয়ে গেল তাদেরকে চিকিৎসা না দেয়া অপ্রত্যাশিত। চাকরির বিষয় নিয়ে এর আগেও বারডেমে আন্দোলন হয়েছে। সবাই মিলে আন্দোলনের মাধ্যমে কিছু ফল হয়েছিল। নিয়োগের বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের পুনর্বিবেচনা করা উচিত।‘