খবর৭১ঃ ১৯৯১ সাল ছিল বাংলাদেশের জন্য আরেকবার গণতন্ত্রের পা পিছলে পড়ার বছর। স্বৈরাচারের পতন, একটি সাধারণ নির্বাচন ও তারপর ক্ষমতার রদবদল ঘটলেও গুণগত পরিবর্তন আসেনি। বরং জাতীয়তাবাদের তপ্ত অঙ্গারের যে কী উত্তাপ, তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম আমরা ময়মনসিংহে বসে। যে বয়েজ হোস্টেলে কদিন আগেও ছিল উপচেপড়া ভিড়, সেখানেই মরুভূমির নিস্তব্ধতা। হোস্টেল থেকে ছাত্রদলের তাণ্ডবে আর পাশাপাশি প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় উৎখাত হতে থাকা ছাত্রলীগ কর্মী–সমর্থকরা যখন হন্যে হয়ে ভাড়া বাসার খোঁজে শহরময় ঘুরে ফিরছে। সে সময়টিতে এটি খুব কঠিন ছিল।
একদিকে মফস্বল শহরে তেমন কোনো ফ্ল্যাট ছিল না। তাছাড়া ময়মনসিংহ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক শহর। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিত্তিক আমাদের মতো যেসব বহিরাগত সে সময়ে ময়মনসিংহে থাকতাম, তাদের আবাসনের ব্যবস্থা ছিল মূলত ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক। তাছাড়া সদ্য হোস্টেল বহিষ্কৃত ছাত্রদের পকেটে যেমন বাড়তির সংকট ছিল, তেমনি শহরের গুটিকয় ফ্ল্যাট মালিকেরও অনিহা ছিল ব্যাচেলারদের বাসা ভাড়া দেয়ায়।
সে সময় আমরা চারজন রামচাঁদ গোয়ালা কাকার ব্রাহ্মপল্লীর তিনতলা বাসার তৃতীয় তলায় ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে ভাড়া থাকতাম। ব্রাহ্মপল্লীর অবস্থান ভৌগলিকভাবে খুব–ই স্ট্রাটেজিক। বাঘমারার বয়েজ হোস্টেল আর চরপাড়ার মেডিকেল কলেজের থেকে আধা কিলমিটারের মধ্যে। সমস্যা একটাই, এলাকাটিতে শুধু বিএনপি না, এক সময়কার মুসলিম লীগারদেরও দাপট ছিল প্রচণ্ড।
আমাদের কারণেই হোস্টেল বহিষ্কৃতরা এই এলাকাতেই প্রথম বাসা খুঁজতে আসতো। তাদের অনেকেই এ সময় প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ সহযোগিতা পেয়েছেন গোয়ালা কাকার। তিনি নিজের দোতলা ফ্যাটটিও ভাড়া দিয়েছেন আমাদের ব্যাচমেটদের–ই। পাশাপাশি তার সহযোগিতায় ব্রাহ্মপল্লীতে আরও অনেক ছাত্রলীগারেরই ঠাঁই হয় এবং একসময় ব্রাহ্মপল্লী হয়ে ওঠে মেডিকেল ছাত্রলীগের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
গোয়ালা কাকা ছিলেন আবাহনীর ক্রিকেটার। খেলেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলেও। তিনি ছিলেন সম্ভবত সবচাইতে বেশি বয়সে অভিসিক্ত জাতীয় দলের ক্রিকেটার। শেষ জীবনে তিনি ছিলেন গ্রেটার ময়মনসিংহ ক্রিকেট ক্লাবের কোচ কাম প্লেয়ার। অসম্ভব ব্যালেন্সড, মিতভাষী আর সেই জামানায় ময়মনসিংহের মুখ উজ্জ্বল করা গুটিকয়েকের অন্যতম। সে কারণে ব্রাহ্মপল্লীর বৈরী পরিবেশেও আমরা শুধু তার কারণেই টিকে ছিলাম।
তার বাসার ভাড়াটে উত্তমদা (আজকের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া) ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে মমেকসুতে ভিপি পদে ইলেকশন করেছিলেন। তার বাসায় ভাড়া থেকে বাবু (আজকের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান) এবং একরাম (বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী) একসময় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মেডিকেল ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
তার বাসা থেকেই শুরু হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের অনেক মিছিল। ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ধাওয়ায় ছত্রভঙ্গ হয়ে ফিরে এসেছে আবার তার–ই বাসায়। তার বাসা থেকে মিছিল করে বয়েজ হোস্টেলে প্রবেশের চেষ্টাও চালিয়েছি আমরা। মমেকসুতে সাহিত্য–সাংস্কৃতিক উৎসবের আমি যখন আহ্বায়ক, সম্ভবত ১৯৯৩ সালের ঘটনা, উৎসব পণ্ড করেই শুধু ক্ষান্ত হয়নাই ছাত্রদলের ক্যাডাররা, হামলা চালিয়েছিল তার বাসাতেও।
সংসদে ভোরের কাগজ রাখার অপরাধেও হামলা চালিয়েছিল ছাত্রদল, সম্ভবত ওই ১৯৯৩–৯৪ সালেই। ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে, বাঘমারার হোস্টেল হয়ে মারামারি গড়িয়েছিল ব্রাহ্মপল্লীতে গোয়ালা কাকার বাসা অবধি। আমি আর বাবু কোনোমতে ব্রাহ্মপল্লীতে পৌঁছেছি, হাতে যে হকিস্টিক খেয়াল–ই নেই। বাসার একতলায় কলাপসেবল গেট আটকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন গোয়ালা কাকা। তাকে না ডিঙ্গিয়ে ছোঁয়ার উপায় নেই কারও আমাদের।
রামচাঁদ গোয়ালা কাকা কখনও বিয়ে করেননি। নিজের জীবনটা তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তার আদরের ভাতিজা–ভাতিজিদের জন্যে। তার বায়োলজিক্যাল কেনো সন্তান নেই, কিন্তু আমাদের মতো অনেকের কাছেই তিনি পিতৃতুল্য। ফেসবুকে বন্ধু মামুনের (আজকের শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ–পরিচালক ডা. কে এম মামুন মোর্শেদ) স্ট্যাটাসেই তা প্রতিভাত।
একজন রামচাঁদ গোয়ালাকে বাঙালি মনে রাখবে দেশের প্রথম গুগলি স্পিনার হিসেবে নিশ্চয়ই, কিন্তু আমি চাই তার ওই পরিচয়টাকেও ছাপিয়ে যাক ‘মুজিব বাগানের মালী’ হিসেবে তার পরিচয়টি। এমনি অনেক রামচাঁদ গোয়ালার সযত্ন ছোঁয়া এবং পরিচর্যার কারণেই এত বাধা–বিঘ্ন আর অত্যাচার–নিষ্পেষণের পরও এত ছায়াদায়ী মুজিব আদর্শের বৃক্ষটি, এত শক্তিশালী বড় আপার হাত। আর তাই আজ নিজে যখন কোভিড আক্রান্ত হয়ে নিস্তরঙ্গ সময়গুলোকে পারিপার্শ্বিক বিশ্লেষণে আর এটা–সেটার কার্যকরণ অন্নেষণে ভালোভাবে কাজে লাগানোর নিরবচ্ছিন্ন সুযোগ পাচ্ছি, তখন কেন যেন ওই হাইব্রিডগুলোর ‘কা–কা’ রব রামচাঁদ গোয়ালা কাকাদের শূন্যতার যে পরিধিটা তাকেই শুধু বাড়িয়ে দিচ্ছে।