ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড: তদন্তে তিন ধরনের গাফিলতির প্রমাণ

0
709
ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড: তদন্তে তিন ধরনের গাফিলতির প্রমাণ

খবর৭১ঃ রাজধানীর গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে তিন ধরনের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের তদন্ত কমিটি। পুলিশের এই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এই ঘটনায় দায়ের করা মামলাটির তদন্ত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মামলার তদন্ত কাজে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির রিপোর্টও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছেন গুলশান থানার ওসি কামরুজ্জামান।

গত ২৭ মে অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্তের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এসপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) আব্দুল আহাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অপর দুই সদস্য হলেন সহকারী কমিশনার (গুলশান) রফিকুল ইসলাম ও গুলশান থানার ওসি কামরুজ্জামান। তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবার (১১ জুন) ডিএমপি সদর দপ্তরে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে তিন ধরনের গাফিলতির প্রমাণ পেয়েছে।

প্রথম গাফিলতি : করোনা সেন্টারে প্রবেশমুখে বর্ধিত আকারে মেডিকেল তাঁবু স্থাপন করা ছিল। এই তাঁবুতে চিকিৎসক ও নার্সদের ডেস্ক। তাঁবু দিয়ে করোনা ইউনিটে প্রবেশ করতে হয়। অদাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি মেডিকেল তাঁবু স্থাপন করার নিয়ম। অর্থাৎ স্থাপিত তাঁবুটি অদাহ্য হতে হবে। কিন্তু সাধারণ মানের দাহ্য তাঁবু স্থাপন করা হয়েছিল। ওই তাঁবুতে পুরাতন এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। তাঁবু অদাহ্য হলে, এ আগুনের সূত্রপাত হতো না। তাছাড়া ওই স্থাপনা স্থাপন করতে রাজউকের কোনো অনুমোদন ছিল না।

দ্বিতীয় গাফিলতি : তাঁবুর এসিতে আগুন ধরে যাওয়ার পর সেটা নির্বাপণ করতে চেষ্টা করেন ক্লিনার আরাফাত। তিনি মেঝে পরিষ্কার করার লাঠিযুক্ত সুতার ঝাড়ু দিয়ে এসির আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ঝাড়ু স্যানিটাইজ জাতীয় তরলে ভেজা ছিল বলে সেটি এসির কাছে নিয়ে যেতেই আগুনের মাত্রা বেড়ে যায়। এসময় আরাফাত চেষ্টা করতে থাকেন আগুন নেভাতে। এসব দেখে কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক সেখান থেকে পালিয়ে যান। ডেস্কে কর্মরত দুই জন নার্স অনবরত ফোন করে আগুনের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে থাকেন। এসির আগুন নীচে একটি বেডের ওপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুন প্রকাণ্ড আকার ধারণ করে। ওই সময় আগুনের ধোঁয়া তাঁবুর দরজা দিয়ে করোনা ইউনিটে প্রবেশ করে। ওই সময় ইচ্ছা করলে ফায়ার স্টুইংগুইশার দিয়ে সহজে আগুন নিভিয়ে ফেলা যেতো। কিন্তু মেডিকেল তাঁবুতে কোনো ফায়ার স্টুইংগুইশার ছিল না। সেখানে অনেক দাহ্য পদার্থ ছিল। সেখানে নূন্যতম দুইটি ফায়ার স্টুইংগুইসার রাখা উচিত ছিল।

তৃতীয় গাফিলতি : করোনা ইউনিটে মোট দুইটি কক্ষ। একটি কক্ষে ৫ জন রোগী ছিলেন। পাশেই একটি কক্ষ ছিল যেটার বাহিরের দরজা দিয়ে ওই কক্ষের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আগুন তাঁবুতে লাগার পর ছড়িয়ে পড়ার আগেই করোনা ইউনিটে দায়িত্বরত নার্স ও এটেনডেন্সরা ইচ্ছা করলে পাশের কক্ষ দিয়ে ঢুকে রোগীদের সহজেই উদ্ধার করতে পারতেন। করোনা ইউনিটে বহির্গমন দরজা ছিল। সেটিও তারা ব্যবহার করেনি। তাঁবুতে আগুন ধরে যাওয়ার পর সেই ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে ওই ৫ রোগী মারা যায়।

এসব বিষয় নিয়ে গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত এক রোগীর আত্মীয়র দায়ের করা মামলাটি তদন্ত চলছে। ইতিমধ্যে পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত রিপোর্টও হাতে চলে আসবে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে চরম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ রয়েছে। মামলা তদন্তের জন্য আমরা ইউনাইটেড হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ৩৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তদন্ত কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।’

ফায়ার সার্ভিসের রিপোর্টে অবহেলার অভিযোগ

অগ্নিকাণ্ডের নেপথ্যে কর্তৃপক্ষের অবহেলাকে দায়ী করেছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটি। তারা বলছে, ফায়ার সনদ ছাড়া বসানো ওই করোনা ইউনিটে অগ্নিনির্বাপণের সরঞ্জাম ছিল না। রাখা হয়নি আগুনের সময় জরুরি নির্গমন পথ। ত্রুটিপূর্ণ জেনেও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত পূরণে মেশিন বসানো হয়েছে করোনা ইউনিটে। অগ্নিনির্বাপণের জন্য রাখা ফায়ার স্টুইংগুইসারগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।

তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক (ঢাকা) দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ‘আমরা অগ্নিকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির বিবরণ এবং একই সঙ্গে প্রতিকারে সুপারিশ করেছি। ভস্মীভূত করোনা ইউনিটটি অস্থায়ীভাবে তৈরি করা ছিল। আগুন যখন লেগেছে তাৎক্ষণিকভাবে একসঙ্গে পুরোটায় লেগে যায়। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নিজের প্রাণ বাঁচাতে সবাই বেরিয়ে নিরাপদে চলে যান। আগুন লাগার সময় রোগীদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়নি।’

গত ২৭ মে রাতে ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডে রিয়াজুল আলম (৪৫), খাদেজা বেগম (৭০), এ্যান্থনি পল (৭৪), মো. মনির হোসেন (৭৫) ও মো. মাহাবুব এলাহী চৌধুরী হিরো (৫৭) নিহত হন। এ ঘটনার পর নিহত এ্যান্থনী পলের মেয়ের স্বামী রোনাল্ড নিকি গোমেজ বাদী হয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৩০৪(ক) ও ১০৯ ধারায় একটি মামলা করেন। মামলায় হাসপাতালের চেয়ারম্যান, এমডি, প্রধান নির্বাহী, পরিচালক, দায়িত্বরত ডাক্তার নার্স, ও সেফটি সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আসামি করা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here