বড়ো ঝুঁকিতে ঢাকা

0
535
বড়ো ঝুঁকিতে ঢাকা

খবর৭১ঃ
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস পাল্লা দিয়ে ছড়াচ্ছে বাংলাদেশেও। করোনার ক্লাস্টার সংক্রমণ (যেখানে একাধিক আক্রান্ত ব্যক্তি) ঝুঁকিতে প্রথমে রয়েছে ঢাকা, দ্বিতীয় নারায়ণগঞ্জ। এ পর্যন্ত মোট ৪২৪ জন আক্রান্তের মধ্যে ঢাকায় ২০৯, নারায়ণগঞ্জে ৫৯ জন। দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা ভাইরাসে সেলিম আকন নামক এক জন স্বাস্থ্য সহকারীসহ ছয় জন মারা গেছেন। এর মধ্যে তিন জন রাজধানী ঢাকার, দুই জন নারায়ণগঞ্জের এবং এক জন পটুয়াখালীর। সবমিলিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ জন। এছাড়া এক দিনে নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন ৯৪ জন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাজধানী ঢাকা। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতিমধ্যে রাজধানীর ৫৮টি এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি ওড়ানো হয়েছে লাল পতাকা। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, করোনা সংক্রমণের তৃতীয় পর্যায়ে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন গুচ্ছ আকার অতিক্রম করে অনির্দিষ্ট বাহকের মাধ্যমে অনির্দিষ্ট এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত না করতে পারায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে এই পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, শারীরিক দূরত্ব প্রত্যেক নাগরিকের মেনে চলা ফরজ। এক্ষেত্রে হেলাফেলা করলে অসময়ে জীবন চলে যাবে। তারা আরো বলেন, গার্মেন্ট শ্রমিকদের কারণে ঝুঁকি বেড়েছে। হঠাৎ করে তাদের বাইরে থেকে ঢাকায় আনা না হলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতো না। বর্তমানে ৯২ জন শ্রমিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন। চাঁদপুরে লকডাউনের মূলে রয়েছেন গার্মেন্ট শ্রমিক।

এপ্রিল দুঃসময়ের মাস : প্রধানমন্ত্রী

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে চলায় চলতি এপ্রিল মাসটিকে ‘দুঃসময়ের মাস’ উল্লেখ করে ইতিমধ্যে দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি ভিডিও কনফারেন্স তিনি বলেন, ‘অন্যান্য দেশ থেকে আমরা যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, তাতে মনে হচ্ছে আমাদের দেশেও এ ধাক্কাটা এপ্রিল মাসে আরো ব্যাপকভাবে আসার কথা। এ রকমই একটা আলামত পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের কিছু প্রতিবেদন আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিছু প্রেডিকশন দেখতে পাচ্ছি। কাজেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমি জানি, এপ্রিল মাসটা আমাদের জন্য খুবই একটা দুঃসময়ের মাস হিসেবে আসছে। সব জায়গা থেকে সে খবর পাচ্ছি।’

সরকার ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ইতিমধ্যে সাধারণ ছুটি ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়িয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউনের কথা বলছে না। এই লকডাউন নিয়েও বিজ্ঞানীরা নানা কথা বলছেন। আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মলিকুলার বায়োলোজিস্ট পিটার থেলেন ও থমাস মেহকে লকডাউনের দুটি ফর্মুলা দিয়েছেন। এর মধ্যে লকডাউন-১ হলো টানা ৪৯ দিন সবকিছু বন্ধ থাকবে। যখন ব্যাপকতা বাড়বে তখনই লকডাউন-১ ফর্মুলা কাজে লাগাতে হবে। আর লকডাউন-২ ফর্মুলা হলো, প্রথমে তিন সপ্তাহ লকডাউন শেষে পাঁচ দিন খুলে দেওয়া হবে। এরপর চার সপ্তাহ লকডাউন শেষে পাঁচ দিন খুলে দিতে হবে। এতে কাজ না হলে লকডাউন-১ ফর্মুলা প্রয়োগ করতে হবে। এদিকে শতাধিক পাঠক ইত্তেফাকে ফোন করে বলেছেন, ‘আমরা বাঁচার জন্য কারফিউ চাই। এখনো সময় আছে, কারফিউ জারি করে মানুষকে ঘরে রাখতে হবে। নইলে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়লে বিনা চিকিত্সায় আমরা মারা যাব।’

এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্য চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জানান, সবারই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। নইলে ক্ষতি জনগণেরই হবে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, করোনার ঝুঁকি সবচেয়ে ঢাকায় বেশি। এর পরেই নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ থেকে শ্রমিকদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যা ঠিক হয়নি। শ্রমিকদের একবার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে আবার ঢাকায় নিয়ে আসাও উচিত হয়নি। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার এটাও অন্যতম কারণ।

নমুনা পরীক্ষা ১১৮৪, সংক্রমণ ৯৪

গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৯৪ জন করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। ফলে দেশে ভাইরাসটিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২৪ জন। গতকাল শুক্রবার দুপুরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা ভাইরাসসংক্রান্ত নিয়মিত হেলথ বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা। নিজের বাসা থেকে যুক্ত হন রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা।

বুলেটিনে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ১ হাজার ২৯৭টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছে ১ হাজার ১৮৪টি। সব মিলিয়ে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৭ হাজার ৩৫৯টি। নতুন নমুনা পরীক্ষায় ৯৪ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ঢাকায় শনাক্ত হয়েছেন ৩৭ জন। রাজধানীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাঁচ জন যাত্রাবাড়ী এলাকার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা নারায়ণগঞ্জকে বলা হচ্ছে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের ‘নতুন এপিসেন্টার’, সেখানে আরো ১৬ জন নতুন রোগী পাওয়া গেছে। নতুন রোগীদের মধ্যে ৬৯ জন পুরুষ, ২৫ জন নারী।

৬ মৃত্যুর তিনটিই ঢাকায়

গত ২৪ ঘণ্টায় যারা মারা গেছেন, তাদের তিন জন রাজধানী ঢাকার, দুজন নারায়ণগঞ্জের এবং একজন পটুয়াখালীর। মৃত ছয় জনের মধ্যে পাঁচ জন পুরুষ, একজন নারী। ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে দুজন, ৫০ থেকে ৬০ এর মধ্যে দুজন, ৬০ এর অধিক একজন এবং ৭০ থেকে ৮০ বয়সের মধ্যে একজন। এছাড়া বৃহস্পতিবার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন ১১২ জন, মারা যান একজন। এর মধ্যে ঢাকা শহরেই আক্রান্ত হয়েছেন ৬২ জন। নারায়ণগঞ্জে ১৩ জন এবং অন্যান্য জেলায় ৩৭ জন আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে পুরুষ ৭০ জন এবং নারী ৪২ জন। বয়স হিসেবে, ১০ বছরের নিচে তিন জন, ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে নয় জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ২৫ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ২৪ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ১৭ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ২৩ জন এবং ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক ১১ জন।

গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত করোনা ভাইরাসে বিশ্ব জুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা এখন পর্যন্ত সোয়া ১৬ লাখের বেশি। মারা গেছেন প্রায় ৯৬ হাজার মানুষ। তবে সাড়ে ৩ লাখের মতো রোগী ইতিমধ্যে সুস্থ হয়েছেন। দেশে রাজধানীর মিরপুর, টোলারবাগ, উত্তরা ও বাসাবোয় বেশি আক্রান্ত হয়েছে। তবে রাজধানীর সব এলাকায়ই সংক্রমণ হচ্ছে। গতকাল আরো তিন সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ধানমন্ডিতেও ১৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। খলিয়াজুড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন স্টাফ নার্স করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। নেত্রকোনা সদরের মদনপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের একজনও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

পরীক্ষা বেড়েছে ১৮ শতাংশ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক সানিয়া তহমিনা ব্রিফিংয়ে জানান, ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষা বেড়েছে ১৮ শতাংশ। এই সময়ে চিকিত্সক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার ৬৬০টি ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম-পিপিই সংগ্রহ করা হয়েছে, ৪১ হাজার ৫০০টি বিতরণ হয়েছে এবং ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭২টি পিপিই মজুত রয়েছে। মোট ১২ হাজার ৬০১ জন এখন হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন জানিয়ে অধ্যাপক ডা. তহমিনা বলেন, ‘আমাদের যে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ক্যাপাসিটি, সেটা আগের চেয়ে বেড়েছে। সারা দেশে সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের জন্য ৪৭০টি প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা তাত্ক্ষণিকভাবে কোয়ারেন্টাইনের সেবা প্রদান করতে পারব ২৪ হাজার ৪৯২ জনকে।

৪ সহস্রাধিক চিকিত্সক-নার্স প্রস্তুত

অতিরিক্ত মহাপরিচালক জানান, সারা দেশে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৫ জন চিকিত্সক ও ১ হাজার ৫৪ জন নার্সকে কোভিড-১৯ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে প্রতিনিয়ত নতুন তথ্য পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য পরামর্শও বদলে যেতে পারে বলে তিনি জানান। ডা. সানিয়া তহমিনা বলেন, প্রতিনিয়ত গবেষণা করে বিভিন্ন রকম তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে। সাত দিন আগে আমরা যে পরামর্শ দিয়েছি, সাত দিন পরে নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে। কারণ এটা একটি নতুন ভাইরাস। ?সুতরাং যেটা আমরা বলছি, এটাকে আপনারা আমাদের অজ্ঞতা হিসেবে না নিয়ে, আমরা যেটুকু জানতাম, সেটুকু আপনাদের কাছে বলেছি। যদি সেখানে কোনো পরিবর্তন হয়, তাহলে অবশ্যই সেটা আমরা আপনাদের জানিয়ে দেব।

প্রসঙ্গত, গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর প্রথম দিকে কয়েক জন করে নতুন আক্রান্ত রোগীর খবর মিললেও গত ক’দিনে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে এ সংখ্যা। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৩৩ জন। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে; যার মূলে রয়েছে মানুষে মানুষে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। মানুষকে ঘরে রাখতে রাজপথের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় টহল দিচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী, র্যাব ও পুলিশ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, আমরা সেই হারে ব্যবস্থা নিচ্ছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here