খবর৭১ঃ অং সান সু চি। এক সময় তাকে মানবাধিকার রক্ষার দূত হিসেবে ভাবা হতো। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় মিয়ানমারের সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গৃহবন্দি জীবন কাটিয়েছেন বছরের পর বছর।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় ১৯৯১ সালে সু চিকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও দেয়া হয়। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার দিন কমিটির চেয়ারম্যান তাকে ‘ক্ষমতাহীনের ক্ষমতা’ বলে আখ্যায়িত করেন।
কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে আপাদমস্তক পুরোটাই বদলে গেছেন তিনি। মানবতার পক্ষে তার সেই আগের অবস্থান আর নেই। রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি নীরব সমর্থন দিয়ে বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যে নিন্দিত হয়েছেন এক সময়ের গণতন্ত্রের ‘আইকন’ সু চি। এবার সেই গণহত্যার অপরাধে আসামি হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে হাজির তিনি।
৭৩ বছর বয়সী সু চি মিয়ানমারের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন করায় ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বেশিরভাগ সময় গৃহবন্দি ছিলেন। এর ফলে তিনি বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতীক হয়ে দাঁড়ান। দীর্ঘ ২৫ বছর পর ২০১৫ সালে তার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) থেকে নির্বাচন করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
তবে প্রকৃত বিজয় আসে আরও পাঁচ বছর পর যেদিন তিনি ১৫ বছরের গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান। ২০১৫ সালের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করলে দেশটির ক্ষমতার ভাগী হন সু চি।
২০১৬ সালে সু চি যখন পশ্চিম ইউরোপ সফরে যান, তখন তাকে বরণ করা হয়েছিল গণতন্ত্রের মানসকন্যা হিসেবে। তার দীর্ঘদিনের সমর্থনদাতা পশ্চিমারা মনে করেছিলেন, সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ি খর্ব করতে তিনি তার ক্ষমতা ও নৈতিকতার অবস্থানকে ব্যবহার করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই বদলে যেতে থাকে তার কর্মকাণ্ড।
বছরে পর বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়েছে তার দেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চালানো দুটি নৃশংস জাতিনিধন অভিযানে বাড়িতে মানুষ হত্যা, নারী ও যুবতীদের ধর্ষণ, পুরো সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ তদারকি করেছে সেনাবাহিনী। এর শিকার হয়ে কমপক্ষে ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেননি সু চি, বরং আরও সেনাবাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন।
জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একবাক্যে বলে আসছে, রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। রয়টার্সসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার অনেক ছবিসহ প্রমাণও মিলেছে।
কিন্তু সবই অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। সবচেয়ে বড় প্রমাণ, প্রাণের ভয়ে ছুটে আসা লাখ লাখ মানুষের ঢল। যাদের কথায় উঠে আসে নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ। মানবিক কারণে যাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। রাখাইনে কী হয়েছে তা বিশ্ববাসীকে সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে দেয়নি মিয়ানমার। তাতে আটকায়নি আদালতের দরজা। জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দেয় আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া। মঙ্গলবার শুরু হয়েছে এর শুনানি।
অনেকেরই ধারণা ছিল, মিয়ানমার বুঝি এই আদালতকেও এড়িয়ে যাবে। কিন্তু এখানেও চতুর চাল চালছে দেশটি। আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন সু চি। গণহত্যায় অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়েই লড়ছেন তিনি।
দেশের ভেতর সু চির পক্ষে একের পর এক সভা-সমাবেশ হচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই জাতিসংঘের আদালতে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সু চি। এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত সু চির বন্ধুমহলও। তারা বলছেন, এতে বিশ্বজুড়ে আরও নিন্দাই কুড়াচ্ছেন তিনি। কিন্তু গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হয়ে দেশের ভেতর অবস্থান আরও সুসংহত করাই হয়তো তার মূল উদ্দেশ্য।