খবর৭১ঃ
নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানি আজ মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে। এ মামলার বাদী পশ্চিম আফ্রিকার ছোটো দেশ গাম্বিয়া। মামলার শুনানিতে গাম্বিয়াকে নেপথ্যে থেকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করবে বাংলাদেশ, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আর কানাডা ও নেদারল্যান্ডস যৌথ বিবৃতিতে সহযোগিতা দেওয়ার কথা জানিয়েছে। এদিকে এই মামলায় লড়তে এরই মধ্যে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি নেদারল্যান্ডস পৌঁছেছেন। তিনি বিশেষজ্ঞ আইনজীবীদের একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
আইসিজের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নেদারল্যান্ডসের পিস প্যালেসে অবস্থিত আইসিজেতে গাম্বিয়ার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মামলাটির শুনানি শুরু হবে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে ১১ ডিসেম্বর বক্তব্য উপস্থাপন করবে মিয়ানমার। এরপর ১২ ডিসেম্বর হবে যুক্তিতর্ক। প্রথমে গাম্বিয়া যুক্তি দেবে, এরপর মিয়ানমার তা খ্লনের সুযোগ পাবে। জাতিসংঘের সদস্য দেশ হিসেবে আইসিজের রায় মানতে মিয়ানমার বাধ্য। এ কারণে এ মামলায় শক্তভাবে লড়াইয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি। গাম্বিয়াকে সহায়তা দেওয়া হবে বলে এক যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে কানাডা ও নেদারল্যান্ডস।
বাংলাদেশ কিভাবে সহযোগিতা করবে?
শুনানি পর্যবেক্ষণে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল নেদারল্যান্ডস গেছে। প্রতিনিধিদলের মধ্যে আছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয়) মাসুদ বিন মোমেন, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার সুফিউর রহমান, ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকারসহ কয়েকজন কূটনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি। এছাড়া কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তিন জন প্রতিনিধিও নেদারল্যান্ডস গেছেন।
বিবিসি জানায়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, মিয়ানমার যাতে মিথ্যা তথ্য দিতে না পারে, সেজন্য বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে তথ্য প্রমাণসহ প্রতিনিধি দল শুনানি উপস্থিত থাকবে। গাম্বিয়া মামলাটি করেছে ওআইসি’র পক্ষ থেকে। যেহেতু রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। সেজন্য ওরা যদি কোনো ধরণের তথ্য চায়, আমরা গাম্বিয়াকে সাহায্য করবো। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘অনেক সময় মিয়ানমার অনেক মিথ্যা তথ্য দেয়। মনে করেন, মিয়ানমার বলে ফেললো যে, আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে অ্যারেঞ্জমেন্ট করে ফেলেছি এবং আমরা ওদের নিয়ে যাব। এমন কথা বললে, তখন আমরা বলবো যে, আমরা চুক্তি করেছি। আমরা একটা শর্ত জুড়ে দিয়েছি যে, আমরা রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিত হলে তারপার আমরা পাঠাবো। এনিয়ে তারা আরো কিছু বলতে চাইলে তখন আমরা আমাদের ডকুমেন্ট দেখিয়ে দেবো। এধরণের প্রস্তুতি নিয়ে আমাদের লোক গেছে।’ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আদালতে রোহিঙ্গাদের আসার প্রেক্ষাপট নিয়েই বেশি বিতর্ক হতে পারে, সে ব্যাপারে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বক্তব্য এবং তথ্য-প্রমাণ প্রস্তুত রেখেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত এ সর্ম্পকিত কমিশনের রিপোর্টসহ সংশ্লিষ্ট সব ডকুমেন্ট গাম্বিয়াকে সরবরাহ করবে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, আমরাও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিয়ানমারের জবাবদিহিতা (অ্যাকাউন্টিবিলিটি) চাই। এটা নিশ্চিত হলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে। রাখাইনে তাদের নিরাপদ বসবাসে নিশ্চিত হবে। মন্ত্রী বলেন, বিচার হবে ‘এভিডেন্স বেইজড’। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা এখানে এসে দফায় দফায় নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে গেছেন। নির্যাতিতদের বক্তব্য ধারণ করেছেন। অং সান সু চি কোর্টে স্বীকার করেন বা না-ই করেন তার সরকারই নির্যাতনকারী সেনা কর্মকর্তাদের ১০ বছরের জেল দিয়েছিল। এগুলো ‘এভিডেন্স’ যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংগ্রহে রয়েছে। আমরা আশাবাদী আদালতে গাম্বিয়া জয় পাবে। মন্ত্রী বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কিছুদিন আগে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেছেন। নিশ্চয়ই চীনের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে বলা হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে চীন এবং বাংলাদেশের অবস্থান অভিন্ন।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি তল্লাশি চৌকিতে বিদ্রোহীদের হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত নিধন অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ব্যাপক হত্যাকা্ল, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মুখে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এই অভিযানে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে বলে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা অভিযোগ তোলে। ঐ ঘটনার দুই বছরের বেশি সময় পর গত ১১ নভেম্বর অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনের (ওআইসি) সমর্থনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ দায়ের করে গাম্বিয়া।
মিয়ানমারকে বয়কটের আহ্বান ৩০ মানবাধিকার সংস্থার
রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বৈশ্বিকভাবে মিয়ানমারকে বয়কটের ডাক দিয়ে এক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিশ্বের ১০ দেশের ৩০টি মানবাধিকার, শিক্ষাবিদ এবং পেশাদারদের সংগঠন। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলার শুনানি শুরুর একদিন আগে সোমবার বৈশ্বিক এই বয়কটের ডাক দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। জার্মানভিত্তিক ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন্স এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়েছে। বিবৃতিতে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা, বিদেশি বিনিয়োগকারী, পেশাদার এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনকে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সংগঠনটি বলছে, এই বয়কটের উদ্দেশ্য মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি সরকারের ওপর অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক চাপ তৈরি করা। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ফরসি ডট কো, রেস্টলেস বিংস, ডেস্টিনেশন জাস্টিস, রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক অব কানাডা, রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ অব ইন্ডিয়া ও এশিয়া সেন্টারের মতো সংগঠনগুলো। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের একাধিক প্রবাসী গোষ্ঠী দ্য হেগের আদালতে শুনানি চলাকালে বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছে। মিয়ানমার সরকারের সমর্থনেও সেখানে সমাবেশের পরিকল্পনা করছেন মিয়ানমারের নাগরিকরা।