খবর৭১ঃ বেশ কিছু দিন আগের কথা। জাতীয় পার্টির জিয়া উদ্দিন বাবলু ভাইয়ের কাছে একটা আড্ডায় শোনা। জেনারেল এরশাদ তখনও জীবিত। সিঙ্গাপুরে কোন একবার চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পথে বিপত্তি বাধল চাঙ্গি বিমানবন্দরে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানের এয়ারবাসের যাত্রা বিলম্বিত। বিমানবন্দরে উপস্থিত আমাদের হাইকমিশনার জেনারেল সাহেবকে পরামর্শ দিলেন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে দেশে ফেরার। কিন্তু জেনারেল সাহেব গো ধরেছেন বিমানেই ফিরবেন। অগত্যা কি আর করা? প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক পর আকাশে ডানা মেলল বিমানের এয়ারবাসটি। খানিকক্ষণ ওড়ার পর থেকেই প্রচন্ড বাম্পিং। বাবলু ভাইরা প্রথমে ভেবেছিলেন বোধহয় খারাপ আবহাওয়াজনিত এই ঝামেলা। হঠাৎ খেয়াল পড়ল ডিসেম্বরে কিসের খারাপ আবহাওয়া? আঁড়চোখে ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলেন এতক্ষণে তো বিমানের ঢাকার কাছাকাছি থাকার কথা, কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে কোথাও তো আলোর রেশমাত্র নেই। বাবলু ভাইয়ের কপালে হাল্কা ঘাম জমতে শুরু করেছে। সোজা ককপিটে হাজির হয়ে পাইলটের কাছ থেকে জানতে পারলেন আসল ঘটনা। ওড়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই বিমানে আবারও যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। তাই এই বাম্পিং। ঢাকাকে জানানো হয়েছে সবকিছু। জানানো হয়েছে বিমানের ভিআইপি প্যাসেঞ্জারদের কথাও। হযরত শাহজালাল এখন প্রস্তুত জরুরী অবতরণের জন্য। এই ফাঁকে তারা বঙ্গোপসাগরের উপর উড়ে বিমানের বাড়তি জ্বালানিটুকু ঝরাচ্ছেন যাতে ঢাকায় জরুরী অবতরণটা নিরুপদ্রুপ হয়। মানে-মানে ভালয় ভালয় ঢাকায় নেমে পরদিনই সংসদে জেনারেল সাহেব বিষয়টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গোচরে আনেন। আর তখনই বের হলো থলের বেড়াল। জোট সরকারের সময় চড়া দামে বিমানের জন্য কেনা হয়েছিল একাধিক লক্কড়-ঝক্কড় এয়ারবাস। এটি তারই একটি, এখন বিমানের গলার কাঁটা।
বাবলু ভাইয়ের কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল নিজের অভিজ্ঞতা। ২০১২ বা ১৩ সালের মাঝামাঝি হবে। নেপালের বিরাটনগরে হেপাটাইটিস ই-ভাইরাসের আউটব্রেক ইনভেস্টিগেশনের কাজে আমি আর ন্যাসভ্যাকখ্যাত আমার অগ্রজ ডাঃ শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর ভাই গিয়েছি কাঠমান্ডুতে। ফেরার দিন ভোর-ভোর বিমানের ফ্লাইট। কোন মতে খেয়ে না খেয়ে ত্রিভুবন বিমানবন্দরে পৌঁছে বিমানের জন্য অপেক্ষায় আছি। বোর্ডিং ব্রিজে বসে বিমানকে দিগন্তে দেখতেও পেলাম। কিন্তু বিমানবন্দরে অবতরণ না করে দিগন্তেই হারিয়ে গেল সাধের বিমানের এয়ারবাসটি। সকালের সেই ঢাকায় ফেরা আমরা ফিরলাম গভীর রাতে। সারাটা দিন কাঠমান্ডুর রস-কষহীন বিমানবন্দরে কাটিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে বিমানে চড়ার পর ঘটনা জেনে কোথায় মেজাজ আরও চড়বে। কোনমতে যাতে সাধের মাথাটা ধরের ওপর নিয়ে নিরাপদে ঢাকায় নামতে পারি, এই দোয়া করতে করতেই একটা ঘণ্টা কেটে গেল! সকালে যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য কাঠমান্ডুতে নামতে পারেনি এয়ারবাস। ঢাকায় ফিরে গিয়ে কোন রকম জোড়াতালির মেরামত শেষে আমাদের ফিরিয়ে নিতে আবার ফিরে এসেছে। বিমানের গুষ্টি-উদ্ধার আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সেদিন দেখলাম এ বছর এরই মধ্যে বিমানের লাভ আড়াই শ’ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। আর ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানের নিত্য নতুন এয়ারক্র্যাফটের অবতরণ তো এখন আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে। আমরা তো ভুলেই গেছি যেÑ একটা সময় ছিল যখন বিমানের জন্য বিমান কেনা মানেই ছিল মান্ধাতা আমলের কোন একটা এয়ারক্র্যাফটকে। কোন এক ভাগার থেকে অতি দামে কিনে এনে বিমানের গলায় আরেকটা ফাঁস হিসেবে ঝুলিয়ে দেয়া। আমার স্পষ্ট মনে, আছে এই ক’দিন আগেও ডিসি-১০ এর মতো ভিন্টেজ এয়ারক্র্যাাফট পৃথিবীতে সর্বশেষ প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট শেষে মার্কিন মুলুকের বিমান জাদুঘরে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছিল সাধের বাংলাদেশ বিমানের লোগো লেজে সেটে। আর সেই বিমান আজ আনছে মেঘদূত আর হংসবলাকা তো কাল রাজহংস। এক সময়কার ‘সিটি অব ঢাকা’ আর ‘সিটি অব চিটাগং’-এর যুগকে পেছনে ফেলে বিমান আজ ড্রিম লাইনারের যুুগে প্রবেশ করছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে, তার দেয়া কাব্যিক নামের একের পর এক নিত্য নতুন উড়োজাহাজে ভর দিয়ে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে শুধু বিমানকে নিত্য নতুন বিমানে সমৃদ্ধতর করছেন তাই নয়, বিমানের ভবিষ্যত প্ল্যানিংয়েও তার নিপুণ হাতের ছোঁয়া। রাজহংসের উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন এবার তিনি উপহার দেবেন কার্গো এয়ারক্র্যাফট। আমার পিএইচডি ছাত্রীর বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়ে তার স্বামী, বিমানের সিনিয়র পাইলটের কাছে জানতে পারলাম প্রধানমন্ত্রী বিমানকে পরামর্শ দিয়েছেন প্রবাসী নির্ভর ঢাকা-ইনচিয়ন-নারিতা আর ঢাকা-নিউইয়র্ক সেক্টর তো বটেই, পাশাপাশি ঢাকা-কলম্বো-মালে আর ঢাকা-বালির মতো দেশের ইমার্জিং মধ্যবিত্তের কাছে ক্রমেই আকর্ষণীয় হয়ে ওঠা ডেসটিনেশনগুলোতেও নিয়মিত ফ্লাইট শুরু করতে।
এতদিন ভাবতাম আর অবাক হতাম, সাড়া পৃথিবী দাপিয়ে-কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে যেসব বিমান সংস্থা, এই যেমন সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, এমিরেটস, ইতিহাদ কিংবা ইদানীংকার ইথিওপিয়ান, এদের কারও পেছনেই তো নেই এক কোটিরও বেশি দেশপ্রেমিক প্রবাসীর সমর্থন। নেই হজের সময় লাখো প্যাসেঞ্জার পাওয়ার গ্যারান্টিও। তারা যদি শুধু ট্রানজিটের বিদেশীদের দিয়ে শ’য়ে শ’য়ে বিমান নিয়ে আকাশ শাসাতে পারে তা হলে কেন বিমান না? এত বড় ফ্লিট ম্যানেজ করতে গিয়ে তাদেও তো নির্ভর করতে হয় বিদেশী এয়ারহোস্টেস থেকে শুরু করে পাইলটদের ওপরও। আমাদের বেলায় তো জিনিসটা এক দমই উল্টো। আমাদের প্লেন চালায় আমাদের লোক আর আমাদের গ্রাহকও আমরাই। আমরা বাঙলীরা দ্ইু-চার মাসের ছুটিতে দেশে ফিরি আবার ছুটি শেষে নির্দিষ্ট তারিখেই প্রবাসে ফিরি। আমাদের ট্রানজিট মানেই তো টরন্টো, নিউইয়র্ক, লন্ডন, সিডনি বা বড়জোর টোকিও।
তারপরও আমাদের বিমান এত ওড়েনি। উড়তে শুরু করেছে সদ্যই। জানি উড়বেও স্বগৌরবে। যেমনটা উড়ছে গোটা বাংলাদেশ। সিঙ্গাপুর হংকং আর নিউজিল্যান্ডকে পেছনে ফেলে আজ এশিয়া মহাদেশের ১৩তম বৃহৎ জিডিপির দেশ বাংলাদেশ। আজকের ব্রিটেন যখন ব্রেক্সিটে বিপর্যস্ত, ইসরাইল যখন জুলছে জুলন্ত পার্লামেন্টের দোলাচালে আর আরেকটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে পাশ কাটাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে না গড়াতে ব্যস্ত তখন আমাদের হাস্যোজ্জ্বল প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করছেন ‘ভ্যাকসিন স্টার’ পদক। হাসছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, হাসছে গোটা বাংলাদেশ। পৃথিবীজুড়ে যখন কেমন যেন অস্থিরতা, ব্যতিক্রম তখন বাংলাদেশ। শুধু উড়ছে তো উড়ছে। আর বাংলাদেশের ঘুড়ির নাটাই যার হাতে তিনি স্থির, অবিচল। জানেন কখন ছাড়তে হবে সুতা আর কখন ধরতে হবে নাটাইয়ে টান। অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে একজন শেখ হাসিনাকে এখন বাংলাদেশের অনেক বেশি প্রয়োজন। জননেত্রীর জন্য প্রত্যাশা একটাই- বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আপনার বিচরণ শতবর্ষী হোক। নিরাপদ থাকুক আপনার হাতে বাংলাদেশের ঘুড়ির নাটাই। উড়তে থাকুক বাংলাদেশের ঘুড়ি।