খবর৭১: সামনে জাতীয় সংসদের রংপুরের একটি আসনের উপনির্বাচন। গত জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদের সর্বশেষ নির্বাচনকে ঘিরে দেশজুড়ে এবং দেশের বাইরেও যে আগ্রহ আর পাশাপাশি উৎকণ্ঠা ছিল, এবারের উপনির্বাচনে তা শূন্যের কোঠায়। কারণও আছে। এই নির্বাচনে কে হারলো আর কে জিতলো তা নিয়ে মানুষের মাথাব্যথা নেই।
এই একটি আসনের জয় পরাজয়ে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় কোন হেরফেরও হবে না। এই উপনির্বাচনকে নিয়ে যা কিছু আগ্রহ তার মূলে প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রংপুরের এই আসনটিতে টানা বেশ কয়েকবারের এমপি ছিলেন তিনি। আসনটি শূন্য হয়েছে তার মৃত্যুতে।
ব্যক্তি এরশাদের প্রতি আমার প্রতিক্রিয়া মিশ্র। তিনি যে শুধু বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আরো একজন হন্তারকই ছিলেন তাই নয়, তিনি এদেশে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। জিয়াউর রহমানের আমলে এদেশে পাকিস্তান আর জামায়াত তোষণ আর মুক্তিযোদ্ধা নিপীড়নের যে মহোৎসবের সূচনা হয়েছিল তা অব্যাহত ছিল এরশাদের সময়ও। শেষ বয়সে সম্ভবত ভুল বুঝেছিলেন তিনি। হয়তো বা কিছুটা পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে যেয়েই জীবনের শেষ কটা বছর গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষায় প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে হাত মিলিয়েছিলেন।
যা হোক এরশাদের মৃত্যুর পরপরই জাতীয় পার্টিতে আরেকদফা ভাঙনের আওয়াজ জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছিলো। বিষয়টা সামনে চলে আসে তার মুত্যুর পর জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচন আর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান নির্ধারণ করতে যেয়ে। দেবর-ভাবী একেবারে মুখোমুখি চলে আসেন এই উপনির্বাচনের প্রার্থী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ভাঙনের দৃশ্যপট যখন চূড়ান্ত, আমার ধারণা আমার মত যে কেউই যখন জাতীয় পার্টির আরেকদফা ভাঙনের পক্ষে চোখ বন্ধ করে লাখ টাকার বাজি ধরতে রাজি, ঠিক তখনই আমরা দেখলাম জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের প্রজ্ঞা আর সঠিক পদক্ষেপ নেয়ায় তাদের দৃঢ়তা। বিবাদমান প্রতিটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছে গেলেন দেবর-ভাবী।
এই উপনির্বাচনকে নিয়ে আরো একবার প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে আওয়ামী লীগও। দীর্ঘদিন ধরে এরশাদের দখলে থাকা আসনটিতে কোন প্রার্থী মনোনয়ন না দিয়ে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে দলটি। নির্বাচনের বেলায় সঠিক সিন্ধান্ত নেয়ায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রজ্ঞা আমরা গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই দেখেছি, দেখলাম এবারও। এরশাদের মৃত্যুর পর রংপুরের অধিকাংশ ভোটার এই আসনের পরবর্তী এমপি হিসেবে এরশাদের পরিবারের কাউকেই প্রত্যাশা করবেন এমনটাই প্রত্যাশিত। আবেগপ্রবণ বাঙালি আবহমান চরিত্রের সাথে তেমনটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। আওয়ামী নেতৃত্ব দেখিয়ে দিলেন নির্বাচনে অংশ না নিয়েও কিভাবে নির্বাচনে জিতে আসা যায়।
উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি’ও। পিপিপি বলে বিশ দলীয় জোটের একটি নাম সর্বস্ব দল বিএনপি’তে বিলীন হয়েছে এই নির্বাচনকে সামনে রেখে। দলের নেত্রী রিটা রহমান বিএনপি’র প্রার্থী হিসেবে এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছে। বিএনপি’র এই সিদ্ধান্ত যেমন আমার কাছে বোধগম্য নয়, তেমনি বোধগম্য নয় রংপুরের ভোটারদের কাছেও।
আমরা বরাবরই দেখেছি বিএনপি যে কোন মূল্যে বিশ দলীয় জোটের বিশে’র হিসাবটা ঠিক রাখে। অতীতে যখনই কোন দল জোট ছেড়ে বেরিয়ে গেছে তখনই তারা যে ভাবেই হোক ঐ দলের নাম কা ওয়াস্তে নেতাদের দিয়ে কোন মতে একটা দল করে বিশ দলে বিশটি দল ঠিক রেখেছে। অথচ এবারের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ দলীয় জোট এখন উনিশ দলীয় জোটে পরিণত হয়েছে। তার চেয়েও বড় কথা কে এই রিটা রহমান।
গত জানুয়ারিতে এই আসনে ধানের শীষ পেয়েছিলেন তিনি, তবে তখন জোটের প্রার্থী হিসেবে। যতদূর জানি তিনি কখনই বিএনপি করেন নি, বিএনপি’র জন্য তার কোন ত্যাগ নেই, নেই মাঠে কোন অবস্থানও। রংপুরের ভোটাররাতো দূরের কথা এমনকি বিএনপি’র নেতা-কর্মীরাও তার পক্ষে মাঠে নামতে নারাজ। রিটা রহমানের একটা যোগ্যতা অবশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর দণ্ডপ্রাপ্ত খুনিদের অন্যতম আনোয়ার পাশার স্ত্রী। এই একটি পরিচয়ই সম্ভবত তাকে দফায় দফায় ধানের শীষ এনে দিচ্ছে।
একটা সময় ছিল যখন আমরা বিরোধী দল বলতে বিএনপি’কেই বুঝতাম। সে সময়টা এখন শুধুই স্মৃতি। গত দুটি জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আবার অংশ নিয়েও বারবার তাদের কাছে গোল খেয়েছে বিএনপি। এবার জাতীয় পার্টি ভাঙনের মুখে পড়লে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের তকমাটি ছুটে যাওয়ার আশংকা ছিল। জাতীয় পার্টির নেতৃত্বের প্রজ্ঞায় তেমনটি ঘটেনি।
মাঠের রাজনীতিতে এখনও জ্বলছে বিএনপি’র প্রদীপ। জাতীয় পার্টি এখানেও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু হারাতে পারেনি এখনও। তবে ইদানিং মাঠের রাজনীতিতে বিএনপি’র যে একের পর এক ভুল, খুনির স্ত্রীকে মনোনয়ন দিয়ে যার আবারো বহিঃপ্রকাশ তাতে কেন যেন মনে হয় বিএনপি ভুলে গেছে ডারউইনের সেই অমোঘ তত্ত্ব, ‘সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট’। সম্ভবত প্রবাসী নেতার হাত ধরে পরবাসী দলেই পরিণত হতে চলেছে তারা।