প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার তহবিল আটকে রয়েছে প্রভিশন খাতে

0
494

খবর৭১ঃ দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও কর্মদক্ষতার অভাবে মানসম্পন্ন সম্পদের পরিমাণ কমেছে ব্যাংকিং খাতে একই সঙ্গে বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আদায় অযোগ্য কু-ঋণের পরিমাণ; যা আর্থিক খাতকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে।

২০০৭-০৮ সালে বিশ্বব্যাপী যে আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয় তার শুরুটা ছিল আমেরিকার ব্যাংকিং খাত থেকে। ওই দেশের ব্যাংকগুলো বেপরোয়া গতিতে গৃহায়ন খাতে ঋণ দেয়। ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট জামানত ছিল না। জামানতের মান অত্যন্ত দুর্বল।

একপর্যায়ে টাকা ফেরত আসছিল না। ব্যাংকগুলোও জামানত বিক্রি করে ঋণ আদায় করতে পারছিল না। তখন ব্যাংকিং খাতে সম্পদের মান খারাপ হতে থাকে। এতে বেড়ে যায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ।

দেউলিয়ার পথে বসে পুরো ব্যাংকিং খাত। তখন সরকার জনগণের করের টাকা ধার দিয়ে ব্যাংকগুলোকে উদ্ধার করেছিল। ওই সময়ে আমেরিকার পুরো অর্থনীতিতে ধস নেমেছিল। অন্যান্য দেশের অর্থনীতির জন্য তা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্যাংকিং খাতকে সেই অভিজ্ঞতার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর প্রায় ৫১ হাজার কোটি টাকার তহবিল আটকে রয়েছে প্রভিশন খাতে। এসব অর্থ তারা বিনিয়োগ করতে পারছে না। আর্থিক খাতে তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে এসব তহবিল আটকে যাওয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন’ বিশ্লেষণ করে তথ্যগুলো পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা রক্ষায় এখন প্রধান উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।

খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন রাখার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। ২০১১ সালে প্রভিশনের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। গত বছর প্রভিশন রাখার প্রয়োজন দেখা দেয় ৫৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলো রাখতে পেরেছে ৫০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। ঘাটতি আছে ৬ হাজার ৬১০ কোটি টাকা।

ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে নিয়মিত ঋণের বিপরীতে ১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের তিনটি শ্রেণীর মধ্যে নিুমানের ঋণে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের ৫০ শতাংশ এবং কু-ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়।

ব্যাংকগুলো প্রভিশন রাখে মুনাফার অর্থ বা মূলধনের অর্থ থেকে। এসব অর্থ প্রভিশন হিসাবে রাখলে তা আটকে থাকে। এগুলোর বিপরীতে কোনো আয় হয় না। এগুলো ঋণ হিসাবেও বিতরণ করতে পারে না। এসব অর্থ আটকে থাকার কারণে অর্থনীতিতে টাকার সঞ্চালন কমে যায়; যা অর্থনীতির প্রতিটি খাতকে আঘাত করে।

অর্থনীতির এসব ক্ষতিকারক দিক থেকে আর্থিক খাতকে রক্ষায় খেলাপি ঋণের হার কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সম্পদের ব্যবস্থাপনার মান ও দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ কম থাকলে ঋণের সুদের হার কমে যাবে। এতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রা কমে যায়। এ সময় ব্যাংকগুলোর আয় বেড়ে যায়। এতে ঋণ বিতরণের সক্ষমতা বাড়ে; যা অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের গতিপ্রকৃতি ও গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছে। এর আলোকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করেছে।

দেশের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৪৫টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে অপরিবর্তিত রয়েছে। বাকি ১২টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ডাবল ডিজিটের উপরে। এদের খেলাপি ঋণের হার ১৫ শতাংশের বেশি।

কিছু ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারণে ব্যাংকিং খাতে সার্বিক সম্পদের মান কমে গেছে। তারপরও কিছু খাতে উন্নতি হয়েছে। এর মধ্যে গ্রামে ব্যাংকিং খাতের প্রসার ঘটেছে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসারের ফলে এই ধারার ব্যাংকিং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নিট খেলাপি ঋণের হার বাংলাদেশে কিছুটা কমেছে। নিট হিসাবে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি ভারতে। তাদের খেলাপি ঋণের হার সোয়া ৫ শতাংশ, ভুটানে ৫ শতাংশ, মালদ্বীপে আড়াই শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ১ শতাংশ, শ্রীলংকায় ২ শতাংশ এবং বাংলাদেশে ২ দশমিক ২ শতাংশ।

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বাড়লেও নিট হিসাবে কমেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে গ্রস খেলাপি ঋণ ৩০ শতাংশ, নিট হিসাবে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে গ্রস খেলাপি ঋণ সাড়ে ৫ শতাংশ, নিট হিসাবে শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোতে গ্রাস খেলাপি ঋণ সাড়ে ৬ শতাংশ, নিট হিসাবে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ।

বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে গ্রস খেলাপি ঋণ সাড়ে ১৯ শতাংশ, নিট হিসাবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। মোট হিসাবে গ্রস খেলাপি ঋণ ১০ দশমিক ৩ শতাংশ, নিট হিসাবে ২ দশমিক ২ শতাংশ।

ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রেখে নিট হিসাবে খেলাপি ঋণ কমিয়েছে। প্রভিশনের কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রা কমেছে। কিন্তু ঋণ আদায় না বাড়লে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।

ব্যাংকিং আমানত বিভাজনের ইতিবাচক পর্যায়ে রয়েছে। মোট আমানতের মধ্যে মেয়াদি আমানতের হার ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ, সঞ্চয়ী হিসাবে আছে ২১ শতাংশ, চলতি হিসাবে ২০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অন্যান্য হিসাবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ ।

মেয়াদি হিসাবে বেশি আমানত থাকলে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করতে পারে। ফলে শিল্প খাতে মেয়াদি ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা বাড়ে। এতে শিল্প খাত চাঙ্গা হয়; যা অর্থনীতিকে টেকসই উন্নয়নের দিকে নিয়ে যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here