ডিজিটাল বিলবোর্ড পরিণত হচ্ছে মৃত্যুফাঁদে, আছে স্বাস্থ্যঝুঁকি !

0
622

খবর৭১ঃ বিজ্ঞাপন! যেকোনও পণ্য সম্পর্কে মানুষকে পরিচিত করানোর প্রথম ধাপ হচ্ছে বিজ্ঞাপন। বছর দুয়েক আগে রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, ব্যানার, এনালগ বিলবোর্ডেই এই সীমাবদ্ধ ছিল বিজ্ঞাপনের প্রচার-প্রচারণা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির কল্যাণে বিজ্ঞাপনেও ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে। সম্প্রতি বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ডিজিটাল বিলবোর্ডকেই বিজ্ঞাপনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছেন। এজন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ঢাকার অলিতেগলিতে তৈরি করে দিয়েছেন ডিজিটাল বিলবোর্ড নামক এই মরণ ফাঁদ।

‘প্রচারেই প্রসার’ কথাটি যৌক্তিক হলেও এই প্রচারই এখন মানুষের বিরক্তির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকায় সন্ধ্যা নামার আগেই রাস্তার দুধারে জ্বালিয়ে দেয়া হয় শত শত এলইডি বিলবোর্ডের লাইট। এগুলোর আলো-আধাঁরের বিচ্ছুরণে সড়কে যানবাহন চালকদের বিভ্রান্তি তৈরি হয়। যা সড়ক দুর্ঘটনার শঙ্কাও বাড়িয়ে দেয়। বিলবোর্ডের কারণে গাড়ি চালকরা হচ্ছেন দিকভ্রান্ত। অপরদিকে এসব ডিজিটাল বিলবোর্ডের লাইটের অতিরিক্ত আলোর ঝলকানিতে মারাত্মক চোখের ক্ষতিতে পড়ছেন নগরবাসী।

চক্ষু বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বিলবোর্ডের অতিরিক্ত আলোতে মানুষের অন্ধত্বও ঘটতে পারে। বড় বিলবোর্ডগুলো নগরীর বিভিন্ন সড়কের মোড়ে লাগানো হলেও ছোটগুলো লাগানো হয় সড়ক ডিভাইডারে কিংবা ফুটপাতের পাশে। যে কারণে অনেক কাছ থেকেই এলইডি থেকে বিচ্ছুরিত আলো গাড়িচালক ও পথচারীদের চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। এর অতিরিক্ত আলো চোখে পড়ায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণে চালকদের সমস্যা হচ্ছে। সড়কের জন্য বিপদ ডেকে আনছে এই বিলবোর্ড।

এদিকে ২০১৫ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশন, নগরীর সৌন্দর্যহানির অভিযোগ এনে বন্ধ করে দেয় বিলবোর্ড ব্যবসা। আকস্মিক এ সিদ্ধান্তে চরম ক্ষতির মুখে পড়েন এ খাতে বিনিয়োগকারী ছোট বড় অসংখ্য ব্যবসায়ী।

এর পরেই, ২০১৬ সালে সিটি করপোরেশন নতুন মোড়কে আনে এলইডি বিজ্ঞাপন। আরেকটি মাধ্যমে এ বাণিজ্য কব্জা করে একটি সিন্ডিকেট। এসব বিজ্ঞাপনে মানা হয়নি কোনও নিয়মনীতি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে ঝুঁকিপূর্ণভাবেই স্থাপন করা হয় এসব ডিজিটাল এলইডি বিলবোর্ড।

বছর তিনেক আগে ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিচ্ছন্ন ঢাকা গড়ার কথা বলে খোদ সিটি করপোরেশনই নগরীর সকল বিলবোর্ড সরিয়ে নিয়েছিল। সেই নগর কর্তৃপক্ষই আবার ঢাকার অলিতেগলিতে সাঁটিয়ে দিয়েছেন ডিজিটাল বিলবোর্ড নামক এই মরনফাঁদ। ২০১৩ সালে ঢাকা সিটি কলপোরেশন বিজ্ঞাপন নীতিমালা করলেও এখন দেখা যাচ্ছে স্বয়ং তারা এই নীতিমালা ভেঙে রাস্তার ধারে লাগিয়েছেন শত শত বিলবোর্ড।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিণ্ন সড়কে মোড়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা শাহবাগ মোড়। অথচ সেখানেই সাঁটানো হয়েছে সবচেয়ে বড় এলইডি বিলবোর্ডটি।

অপরদিকে রাজধানীর মৎস্য ভবন থেকে কাকরাইলের প্রধান বিচারপতির বাসভবন হয়ে সোনারগাঁও মোড়, গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে শিক্ষা ও মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগ, শাহবাগ থেকে কাওরানবাজার, পান্থকুঞ্জ পার্ক, হেয়ার রোড, আবদুল গনি রোড তাঁতিবাজার ও ধানমন্ডি এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে এলইডি বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। এই বিলবোর্ড লাগানোর ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের বর্তমান নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। অপরদিকে নতুন করে কোনও নীতিমালাও তৈরি করা হয়নি।

সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, ডিএসসিসি মেয়রের ঘনিষ্ট একটি মহল গেল তিন বছর যাবত এলইডি বিজ্ঞাপনের ব্যবসা করে প্রায় ৫০ কোটি টাকার সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ২০ টাকা মিনিট হারে দৈনিক গড়ে ১০ ঘণ্টা চলতে থাকে এসব ডিজিটাল বিলবোর্ড। এবং এই দরে শুধুমাত্র ছোট ৯৫০ টি বিলবোর্ড চালিয়ে দৈনিক আয় হয় প্রায় ১ কোটি ১৪ লাখ টাকা। বছরে এই আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪১০ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

১৫০ কোটি টাকার এই বাণিজ্যে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

জানা যায়, ডিএসসিসিতে প্রায় ছোট আকারের ৯৫০ টি মাঝারি আকারের ২০ টি এবং ছোট আকারের ১৬ টি এলইডি বিলবোর্ড স্থাপনের অনুমতি রয়েছে। আর সরকারি হিসাবে এসব এলইডি থেকে ৩ বছরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা। কিন্তু ডিএসসিসির হিসাব অনুযায়ী এখান থেকে আয় হয়েছে মাত্র ৮২ লক্ষ টাকা। বাকি টাকা লোপাট করে নিচ্ছে একটা সিন্ডিকেট।

এলইডি বিলবোর্ডের বিভ্রান্তি বিষয়ে ওয়েলকাম পরিবহনের চালক মন্টু মিয়া বলেন, ‘আমরা যতদূর জানি সন্ধ্যা হওয়ার পরে লাইটগুলো জ্বালানোর কথা। কিন্তু বিকাল ৫ টার পরেই এসব লাইট জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এসব লাইটের দিকে চোখ পড়লে আর কিছু দেখতে পাই না। এর আলো এতো বেশি যে তাকানোর পরে ২-৪ সেকেন্ড কিছুই দেখা যায় না। তখনই দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তখন আমাদের ড্রাইভারদের দোষ দেয়া হয়। লাইটগুলো রাস্তার পাশ থেকে সরিয়ে নিলে যানবাহন চালকদের জন্য ভাল হয়।’

শাহবাগ মোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হান মাসুদ জানান, এসব ডিজিটাল বিলবোর্ড মানুষের অনেক ক্ষতি করছে। এটার দিকে তাকালে ১ মিনিটের মত কিছু দেয়া যায় না। শাহবাগের মত জায়গায় এতো বড় একটা অতিরিক্ত আলোর বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। যেটার জন্য পিজি, বারডেম হাসপাতালে আসা রোগীদের বেশি ক্ষতি হচ্ছে। এটার জন্য মাঝেমধ্যে চালকরা ঝাপসা চোখে পথ হারিয়ে গাড়ি তুলে দিচ্ছে পথচারীদের উপর। ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

একই জায়গায় পাঠাও চালক হাসান আরিফ বলেন, ‘এসব বিলবোর্ডে বেশি ক্ষতি হয় মোটরবাইক চালকদের। কারণ এসব এলইডি লাইটগুলো মূলত রাস্তার ধারেই স্থাপন করা। আর মোটরবাইক চালকরাও অনেকটা ফুটপাতের পাশেই থাকে। তাই এসব লাইটের আলো মোটরবাইক চালকদের চোখে সরাসরি ইফেক্ট ফেলে।’

বিলবোর্ডের আলোর ঝলকানিতে চোখের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ড. জি এম মোস্তফা বলেন, ‘দেখুন প্রতিটি মানুষের চোখেই আলো সহনীয় একটা মাত্রা থাকে। সেটা যখন অতিরিক্ত হবে তখন অবশ্যই চোখের ক্ষতি হবে। আর ঢাকার এসব বিলবোর্ডে আলোটা একটু বেশিই। আমাদের দেশের মানুষ এটায় অভ্যস্ত নয়। তাই তাদের আরও বেশি কষ্ট হচ্ছে এটার বিচ্ছুরিত আলো সহ্য করতে। বিলবোর্ডে তাকানোর পর দৃষ্টি ফিরে আসতে ১৫ সেকেন্ড সময় লাগে। এতে চোখের সামান্য ক্ষতিসাধন হয়। তবে এভাবে চলতে থাকলে ঢাকায় বসবাসরত মানুষের চোখের সমস্যার অন্যতম একটা কারণ হবে এইসব এলইডি বিলবোর্ড।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক সার্কেল) আনিছুর রহমান বলেন, ‘এসব বিলবোর্ড নীতিমালা অনুসরণ করেই নির্মাণ করা হয়েছে। আর এতে নগরীর সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু এলাকা ছিলো অন্ধকার, সেই এলাকা এই ডিজিটাল বিলবোর্ডের কারণে এখন আরও আলোকিত হয়েছে। তবে জনসাধারণের ডিজিটাল বিলবোর্ডে ক্ষতি হচ্ছে এমন কোনও অভিযোগ এখনও আসেনি। অভিযোগ আসলে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here