খবর৭১ঃএই প্রথম ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ মাতাচ্ছেন বাংলাদেশি ফুটবলার হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী। তিনি খেলছেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলে।
বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন ফুটবলার অতীতে দেশের বাইরের লিগে খেললেও তা আটকে ছিল প্রতিবেশী দেশের মধ্যেই। ক্লাব ফুটবলের মহাযজ্ঞ যে ইউরোপে, সেখানে মানের বিচারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বের স্বপ্ন সুদূর পরাহতই।
এমন একটি অবস্থায় বিশ্বখ্যাত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে যদি কোনো বাংলাদেশি খেলোয়াড়ের নাম চলে আসে, তাতে বসতে হয় একটু নড়েচড়েই।
হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট গ্রামের দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ চৌধুরী এবং মা রাফিয়া চৌধুরীর তিন সন্তানের মধ্যে সবার বড় ঝাঁকড়া চুলের হামজা চৌধুরী। হামজার জন্ম ইংল্যান্ডের লাফবারা শহরে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড়।
একটি বিশেষ কারণে হামজাকে নিয়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে বেশ মাতামাতি। সেটি হলো মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। সেই সঙ্গে এই তরুণ বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান। যে কারণে পাশ্চাত্য ফুটবলের রঙিন দুনিয়ায় বাংলাদেশের নামটিও বারবার উচ্চারিত হচ্ছে। আর এই কারণেই হামজাকে নিয়ে গর্ববোধ করছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
বিষ্ময়কর হামজার ফুটবল প্রতিভা জানতে হলে জানতে হবে ইংলিশ ফুটবলের কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা সর্ম্পকে।
বিশ্বকাপ ফুটবলের বাইরে ফুটবল জগতের অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ আসর ইংলিশ ফুটবল লিগ। এই লিগের মোট চারটি ধাপ। দেশের সেরা ২০টি ক্লাব নিয়ে হয় প্রিমিয়ার লিগ। দ্বিতীয় সারির ২৪টি ক্লাব খেলে চ্যাম্পিয়নশিপ। তারপরে যথাক্রমে ‘লিগ ওয়ান’ এবং ‘লিগ টু’।
এই দুটি লিগেও ২৪টি করে ক্লাব। চার ধাপের মোট ৯২টি ক্লাবের সমন্বয়ে গঠিত ইংলিশ ফুটবল লিগের প্রতিটি ধাপই একটি আরেকটির সঙ্গে যুক্ত। এসব লিগ পর্বের ক্লাবগুলো পেশাদার ক্লাব হিসেবে স্বীকৃত।
প্রিমিয়ার লীগের ২০১৬ সালের চ্যাম্পিয়ন হয় লেস্টার সিটি। এই ক্লাবের হয়ে গত মৌসুমে (২৮ নভেম্বর ২০১৭) হামজার অভিষেক ঘটে ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসরে। এবারও শীর্ষস্থানীয় এই ক্লাবের মূল দলে আছেন বাঙালি পরিবারের সন্তান হামজা চৌধুরী।
মোট ৩০ জনের সমন্বয়ে হয় ক্লাবের মূল দল। পারফরম্যান্সের ওপর মাঠে নামার বিষয়টি নির্ভর করে। লেস্টার সিটির অনূর্ধ্ব–২৩ দলের অধিনায়ক হামজা চৌধুরী অথচ বয়স ছুঁয়েছে কেবল ২১ বছর।
তবে মাঠের ক্ষিপ্রতায় বয়সের সীমা ডিঙিয়েছেন মূল দলে গিয়ে দুনিয়ার বাঘা বাঘা ফুটবলারকে পেছনে পেলে গত মৌসুমে লেস্টার সিটির হয়ে প্রিমিয়ার লিগের মোট আটটি ম্যাচ খেলেন। এর আগে ২০১৫-১৬ মৌসুমে বার্টন অ্যালভিয়ন হামজাকে ভাড়া করে (লোন) নিয়ে যায়।
ক্লাবটির পক্ষে ১৮ বছর বয়সেই খেলেন লিগ ওয়ান। ভালো খেলে ক্লাবটি ওই বছর চ্যাম্পিয়নশিপে উন্নীত হয়। পরের বছর বার্টন অ্যালভিয়ন আবারো হামজাকে ভাড়ায় নিয়েছিল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে।
ইংল্যান্ড জাতীয় দলের জন্যও খেলছেন হামজা। চলতি বছরের ২৬ মে অনূর্ধ্ব–২১ জাতীয় দলে তার অভিষেক। ইতিমধ্যে মেক্সিকো, বাহরাইন, আলজেরিয়া, রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের বিপক্ষে মাঠে নেমেছেন। যারা ফুটবল প্রতিভা সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা সহজেই বুঝেন অচিরেই হামজা ইংল্যান্ড মূল দলে খেলবেন।
হামজা দেওয়ানের মা রাফিয়া চৌধুরী জানান, ছোটবেলা তার ফুটবলের প্রতি ছিল বেশ ঝোঁক। যে কারণে চার বছর বয়স থেকেই ফুটবল খেলতে নিয়ে যেতাম। পাঁচ বছর বয়সে হামজাকে লাফবারা ফুটবল ক্লাবে ভর্তি করা হয়। তখনই নিজের চেয়ে বয়সে দু-এক বছরের বড়দের সঙ্গে খেলত হামজা। ছয় বছর বয়সে এক ম্যাচ খেলতে গিয়ে ফুটবল ক্লাব নটিংহাম ফরেস্টের খেলোয়াড় অনুসন্ধানী দলের নজরে পড়ে হামজা। কয়েক দিন পর অন্য একটি ম্যাচে লেস্টার সিটির অনুসন্ধানীরাও তার দিকে দৃষ্টি ফেলে। উভয় দলই তাকে নিতে চায়।
হামজার বাবা দেওয়ান গোলাম মোর্শেদ চৌধুরী বললেন, দুটি ক্লাব তাকে নিতে চাইলে আমরা শেষ পর্যন্ত লেস্টার সিটিতে হামজাকে ভর্তি করি। স্কুল ছুটির পর সপ্তাহে দুদিন করে প্রশিক্ষণ। আর শনি ও রোববার থাকত ম্যাচ। এ কারণে তারা লেস্টার শহরে চলে আসি লাফবারা শহর থেকে । ২০১৩ সালে জিসিএসই (বাংলাদেশে এসএসসি) সম্পন্ন করার পর লেস্টার সিটি একাডেমিতে দুই বছরের বৃত্তি পায় হামজা। ফুটবল প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পড়াশোনারও দায়িত্ব নেয় তারা। সাধারণত ১৮ বছর বয়স হলেই পেশাদার ফুটবলার হিসেবে চুক্তি করতে হয়।
নিজেকে বাঙালি পরিচয়ে গর্বোবোধ করে জানিয়ে হামজা চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রতি আছে ভালোলাগা, ছয় মাস বয়স থেকে পরিবারের সঙ্গে হামজার বাংলাদেশে সফর শুরু। এ পর্যন্ত ২০ বার বাংলাদেশে গিয়েছেন। তিনি বাংলা বলতে পারেন হবিগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায়।
সর্বশেষ তিন বছর আগে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন হামজা। পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর প্রশিক্ষণ ও খেলার চাপ বেশ বেড়ে গেছে। সপ্তাহে পাঁচ দিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ। থাকে ম্যাচ। ফলে বেড়ানোর সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তবে সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে যেতে চান এই ফুটবল তারকা।
তখন মনে পড়ল প্রিমিয়ার লিগে অভিষেকের পর ব্রিটিশ গণমাধ্যমকে বলা হামজার কথাগুলো। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বাবা-মা দুজনেই বাংলাদেশি। আমার পরিবার বিশাল। বাংলাদেশিদের পরিবার সবখানে।’
এই তরুণ বাংলাদেশি পরিবারের সন্তান। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের অগ্রযাত্রার পথে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা এই তরুণ নিজের বাঙালি পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করেন।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক মুনজের আহমদ চৌধুরী জানান, প্রবাসে বাংলাদেশিদের কোনো কাজে বির্তক সৃষ্টি হলে আমরা যেমন ব্যাথিত হই তেমনি বাঙালির ভাল কাজে গর্ববোধ করি। ইংল্যান্ডে হামজার জনপ্রিয়তা আমাদের বাঙালি কমিউনিটিকে গর্বিত করে। নতুন প্রজন্মের ব্রিটেনে আমাদের সন্তানরা যারা খেলাধুলায় ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাদের জন্য হামজা চৌধুরীরা প্রেরণার উৎস। এ দেশে জন্ম নেয়া বাংলাদেশিদের কাছে বাংলাদেশ তাদের মা বা বাবার দেশ থাকলেও হামজার বেলার ব্যাতিক্রম। হামজা নিয়মিত দেশে যেতে ভালবাসেন। বাংলাদেশ তাকে টানে।
বাংলাদেশে ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন জানান, এটা খুবই ভাল খবর যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একটি ছেলে ইংল্যান্ড মাতাচ্ছেন। হামজা একজন জাতপ্রতিভা। তার কারণে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পাবে। দেশের ফুটবলপ্রেমি জনগণ এবং আমি ব্যাক্তিগতভাবে থেকে হামজাকে অভিনন্দন জানাই। আশা করছি তার থেকে নতুন প্রজন্ম উৎসাহ পাবে।