খবর ৭১ঃ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, যিনি হিমালয় কোলের ওই স্থলবেষ্টিত দেশে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ঘটাতে চান।
৩০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে শুক্রবার সকালে ঢাকা পৌঁছান ভুটানের প্রধানমন্ত্রী।
ঢাকার একটি হোটেলে ওই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, আমার দেশ স্থলবেষ্টিত, তা সত্যি। কিন্তু বন্ধুরা, আমাদের হৃদয় বন্ধ নয়। ব্যবসার জন্য আমাদের দুয়ার উন্মুক্ত।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সাবেক ছাত্র ডা. শেরিংয়ের হৃদয়ে একটি বিশেষ জায়গা জুড়ে আছে বাংলাদেশ।
গতবছর ৭ নভেম্বর নিজের দেশে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবার বাংলাদেশ সফরে এসে শুক্রবার বিকালে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন এ দেশের ব্যবসায়ীদের।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতাদের উদ্দেশে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ যদি মনে করে যে ভুটানিরা তাদের কাছের মানুষ, আমার মনে হয়, আপনাদের এগিয়ে আসা উচিৎ।
গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর এটিই বিদেশি কোনো সরকারপ্রধানের প্রথম বাংলাদেশ সফর।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর সবার আগে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল ভুটান। সে কারণে দুই দেশের সব সময়ই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান।
কিন্তু ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, এটা যথেষ্ট নয়।
আমাদের মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য এত বেশি কেন? আমি শুনেছি আপনাদের রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু ভুটানে আপনারা রফতানি করেন মাত্র ৩ মিলিয়ন ডলারের।
আমরা যদি সত্যিই ঘনিষ্ঠ হই, আমার মনে হয় আমাদের ব্যবসাটা বাড়ানো উচিৎ। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এখন যেটা আছে তা যথেষ্ট নয়।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এই আয়োজনে এই অনুষ্ঠানে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মূল বক্তা।
অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, সহ-সভাপতি মো. মুনতাকিম আশরাফ, ভুটান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট ফুব জাম এ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
আগামী দিনগুলোতে বাণিজ্য সম্পর্ক আর এগিয়ে নিতে এ অনুষ্ঠানে দুই দেশের শিল্প ও বণিক সমিতির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়।
লোটে শেরিং মনে করেন, সমঝোতার পর যদি কোনো উদ্যোগ না থাকে, আন্তরিকতা যদি না থাকে, তাহলে ওই সমঝোতা স্মারকও কোনো অর্থ বহন করবে না।
ভুটান সরকারের তরফ থেকে বলব, এই সমঝোতার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ যাতে নেওয়া হয়, আমাদের দিক থেকে আমরা তা নিশ্চিত করব। আমরা যা বলছি, তা যেন কাজের রূপ পায়, তা আমি দেখব।
এ বিষয়ে মনে কোনো দ্বিধা নিয়ে কারও যাতে ফিরতে না হয়, সেজন্য অনির্ধারিতভাবেই তিনি নিজের বক্তৃতার পর প্রশ্নোত্তর পর্বের জন্য আলোচনা উন্মুক্ত করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেরিং বলেন, আপনাদের আমি বাণিজ্য বাড়াতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাব। সবার আগে আমাদের মনকে উন্মুক্ত করতে হবে; নিশ্চিত করতে হবে, মনে যাতে কোনো দ্বিধা না থাকে।
যদি খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসতে পারি, আমার বিশ্বাস, কোনো বাধাই আর বাধা হবে না। নানাভাবে আমরা বাণিজ্যটা বাড়িয়ে নিতে পারব।
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষ এখন ব্যবসার পিপিপি মডেল নিয়ে কথা বলে। এর মানে হল ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ’ (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব)।
ডা. শেরিংয়ের মতে, বাংলাদেশ ও ভুটান অনেক ক্ষেত্রেই একসেঙ্গ কাজ করতে পারে। এখনও অনেক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র আছে, যেগুলো যাচাই করে দেখা হয়নি।
ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ভুটানে রয়েছে ৩০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা। এর মধ্যে মাত্র পাঁচ হাজার মেগাওয়াট এখন উৎপাদন করা হচ্ছে।
এ খাতের উন্নয়নে তহবিল যোগানোর পাশাপাশি কারিগরিভাবে সহযোগিতা দিচ্ছে পাশের বড় দেশ ভারত। ভুটানের জলবিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশও বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।
সেক্ষেত্রে ভুটানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরবরাহের বিষয়ে এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেরিং বলেন, আইনি কোনো জটিলতা তাতে নেই। কিন্তু তা করতে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করতে হবে, কেননা ভারতের ওপর দিয়েই সরবরাহ লাইন নিতে হবে।
ভুটান সরকারের একজন কর্মকর্তা এ সময় বলেন, ভারতকে আগে এ বিষয়ে একটি নীতিমালা করতে হবে, যাতে তাদের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন নেওয়া যায়।
আর মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেরিং বলেন, এটা নিয়ে ভুটানের দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই। বরং তারা আগ্রহী।
পর্যটকদের যাওয়া আসা নিয়েও ভুটানের কোনো আপত্তি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, তবে আমাদের পরিবেশ আর সংস্কৃতির ওপর এর প্রভাবটা যেন যথাসম্ভব কম হয়।
ভুটান বিশ্বের একমাত্র ‘কার্বন নেগেটিভ’ দেশ। যে পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড ভুটান নির্গমন করে, তার প্রায় তিনগুণ শোষণ করে৷ কিন্তু এই ধারা বজায় রাখা কঠিন হয়ে যাওয়ায় পর্যটনের কারণে পরিবেশ দূষণ নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ রয়েছে ভুটানিদের মধ্যেভ
সে কারণে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে (বিবিআইএন) সরাসরি মোটর যোগাযোগের চুক্তি করার উদ্যোগ নেওয়া হলে ভুটানের পার্লামেন্ট পরিবেশ রক্ষার কারণ দেখিয়ে তা আটকে দিয়েছিল।
এফবিসিসিআইয়ের এই অনুষ্ঠানের আগে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টালে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করে এসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, নিয়ন্ত্রিতভাবে হলেও যাতে ওই চুক্তিতে ভুটান আসে, সেই অনুরোধ তিনি রেখেছেন।
আমি উনাদের বলেছি, নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিবেশকে বাঁচিয়েই এটা আমরা শুরু করতে পারি কি না। আমার প্রস্তাবে তাদের বেশ ইতিবাচক মনে হয়েছে